শনিবার, সন্ধ্যা ৭:৪৭, ১৬ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শনিবার, সন্ধ্যা ৭:৪৭, ১৬ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মন বনাম দেহ/সালাতে মুক্তি

শামছুল হুদা মোমিন মাস্টার

মন অসীম অখন্ড, দেহ সসীম খন্ডিত। মন নিজেই তাহার দেহ সৃষ্টির মূল কারণ। ইহাই সৃষ্টির বিধান। শেরেক করা অর্থাৎ বস্তু জগতের সঙ্গে মোহের আকর্ষন রাখা মনের বস্তুবাদী স্বভাব ধর্ম। এইরূপ আকর্ষনের দ্বারা সে বারে বারে দেহ লাভ করিয়া থাকে। মূলতঃ ইড়ফু রং হড়ঃযরহম নঁঃ ঃযব ফবংরৎবসবহঃ ড়ভ ঃযব সরহফ. শেরেক অর্থাৎ বস্তুর সকল আকর্ষন মন হইতে উচ্ছেদ করিতে পারিলে সৃষ্টির সকল প্রকার বন্ধন হইতে মুক্তি লাভ করিয়া বারবার মরদেহ প্রাপ্তির দুঃখ হইতে রেহাই পাওয়া যায়।

দেহের কর্তা হিসাবে মন যদি মুক্তি লাভের অনুশীলন না করে তবে বারে বারে সে দেহ কারাগারে আবদ্ধ বা বন্দি হয়। আর দেহ ধারণ করা মানেই আজাব বা শাস্তি প্রাপ্তির অবস্থা অর্জন করা এবং দেহের বিস্তৃতির অবসান ঘটাইতে পারে না’ কারণ সে বিস্তার মুখী। ফলে তাহাকে বার বার জন্ম ও মুত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিতে হয়।তুলনীয় বাক্য সূরা ফজর এর ২৫ ও ২৬ নং আয়াত এখানে প্রাণিধান যোগ্য। সৃষ্টি ও ¯্রষ্টা দুইটি আলাদা নহে। আল্লাহ তাঁহার নিরাকার অবস্থা হইতে সাকারে আসেন এই বস্তু জগতের অসংখ্য বস্তু ও জীবরূপে নিজেকে বিকশিত করিয়া। এই বস্তুরূপী বস্তু জগতে তিনি আহাদ আল্লাহ রূপে বিকশিত, যেইখানে সবকিছু তাঁহারই শরীর তিনিই তিনি নম।

এই আহাদ জগতে মানুষ শ্রেষ্ট জীব তাহার মধ্যে তিনি স্বকীয় একটি সত্ত¡া দিয়াছেন এবং নিজে রুহরূপে প্রত্যেকের মধ্যে লুকায়িত আছেন। এই স্বকীয় সত্ত¡া বলে মানুষ নিজেকে তাহার রব হইতে বিচ্ছিন্ন মনে করে এবং স্বেচ্ছাচারিতা করে। স্বেচ্ছাচারী মন দুনিয়াদার, আর এই দুনিয়াদারী জীবনই জাহান্নামের জীবন। মৃত্যুর পর মানুষ যখন দেহ ত্যাগ করে তখন এই আহাদ জগৎ হইতে ক্ষনিকের জন্য মুক্তি লাভ করে। এই সময়ে সে দেখিতে পায় তাহার রবকে এবং তাহার নিজের জন্ম-জন্মন্তরে বহু শাস্তিপূর্ণ দুনিয়ার জীবন সমূহকে। মৃত্যু পরবর্তী এই অবস্থায় মানুষকে শাস্তি দেওয়া হয় না। যতক্ষণ না তাহাকে আহাদ তথা কর্ম/তকদীর অনুযায়ী জীবদেহ দেওয়া না হয়। পরবর্তী আহাদ তথা দেহ দান করা পূর্ব পর্যন্ত তাহার বিশ্রাম। শাস্তি তাহার জন্য পরবর্তী আহাদ জগতের জীবনে এবং এই শাস্তি শুধু পরবর্তী একটি আহাদ জগতের ইহ জীবনের জন্য স্থায়ী। মৃত্যু পরবর্তী এই অবস্থা বন্ধনহীন। বন্ধন আসে পরবর্তী আহাদ জগতের জীবনে। এবং এই দেহ বন্ধন চিরস্থায়ী নয়। পরবর্তী মুত্যু দ্বারা আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

বিষয় মোহে আপ্লুত অবস্থাটাই মনের জুনুব বা অপবিত্র অবস্থা। বিষয়ের প্রতি আসক্তিকে বলে শেরেক। নফসের জন্য শেরেক অতি গুরুতর অমার্জনীয় অপরাধ। বিষয় বাসনায় মানবীয় নফস বিষম অবাধ্য, রাজদ্রোহী, (পরমকর্তা তথা) রুহের নির্দেশ পালনে অবাধ্য।

দেহের মধ্যে মনের গতি কোন দিকে তাহাই সাধনার বিচার্য বিষয়। মনের অবলম্বন বা বিহার ক্ষেত্র তাহার দেহ। অতএব মন তাহার বাসস্থান এই দেহের নানারূপ চাহিদার দিকে গর্ভীর কার্যকর সালাতের মাধ্যমে ধ্যানের দ্বারা বিচরণ করিয়া আপন চঞ্চল গতি বিধি লক্ষ করিয়া চলিবে। ইহাতে মন ক্রমশ সংযত হইতে থাকিবে এবং বস্তুর প্রতি তাহার মোহাকর্ষন ক্রমশ কমিতে থাকিবে। এই রূপে সে “আল্লাহর ফজল হইতে” অর্থ্যাৎ ধ্যানের সুফল হইতে মুক্তি প্রাপ্তির আকাংখা করিতে থাকিবে। এইখানে সুরা জুমার ১নং আয়াতের ব্যাখ্যা মাওলা সদর উদ্দিন আহম্মদ কর্তৃক দেয় সৃষ্টির রহস্যের ব্যাখ্যা প্রাণীধান যোগ্য। সৃষ্টির মধ্যে সর্বত্র আল্লাহর সেফাত সমুহের প্রকাশ চলিয়াছে। পবিত্রতা প্রকাশ অর্থই তাঁহার সেই সেফাত প্রকাশের ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ করিয়াছেন সেখানে পবিত্র ভাবে অবাধে প্রকাশিত হইতেছে। তাহাতে ঐ সৃষ্টিগুলির ব্যতিক্রম করিবার অবকাশ বা শক্তি কাহারো নাই। মানুষের মনে আসিয়া ইহা ব্যতিক্রম ঘটিতেছে। মানুষের মনে ভূল চিন্তা তথা অপবিত্র চিন্তা প্রকাশের অবকাশ রহিয়াছে। বুদ্ধি পরিচালনার স্বাধীনতা থাকিবার কারণে (ঋৎবব রিষষ ধহফ পযড়রপব) মানুষ তাহার মনের মধ্যে আপন আমিত্ব নামক অপবিত্র প্রকাশই অধিক করিয়া থাকে। ইহার ফলে তাহার মধ্যে আপন রব নিজ অভিব্যক্তি সহকারে আপন ইচ্ছামতো অবাধে তাহার প্রকাশিত হইতে পারিতেছে না।
মনে আমিত্বের অবস্থিতির পর সালাত ও জাকাত দ্বারা পূনরায় যখন সে উহা বর্জন করিতে পারিয়া তাহার রবের সেফাতেরই প্রকাশ আপনাতে অব্যহত রূপে করিতে পারিবে তখন উহাই হইবে তাহার মনের নিকট আল্লাহর প্রশংসা (চৎধরংব ড়ভ অষষধয).

মূলত মানুষ তাহার মধ্যে আমিত্বের পরিপূর্ণ বিনাশ না করিতে পারিলে সে তসবীহ করিতে পারে না--- তসবীহ করিতে পারে না বলিয়া উহা প্রশংসাও হয় না। আমিত্ব বিসর্জনপূর্বক মানুষ তসবীহ করিতে শিখিলে তখন উহা হামদ বা প্রশংসা হয়। মানুষ জান্নাতের উচ্চ পর্যায়ে যাইয়া সারা বিশ্বের রবরূপে তাহার প্রশংসাই অবলোকন করিয়া থাকে।

নফস দেহের রাজা। নফসের রাজা রূহ। নফসের কার্যক্রমের ফলেই দেহ গঠিত হয়। তাই ক্ষণস্থায়ী দেহের উপর নফসের রাজত্বও ক্ষণস্থায়ী। এই রাজত্বকে ক্রমোন্নতির পথে লইয়া যাওয়ার ব্যবস্থা রাখিয়াছেন রাব্বুল আল-আমিন আল্লাহ। দেহ এবং মনের তথা রূপের (দেহের) এবং অরূপের (মনের) সম্মিলিত লীলা সৃষ্টি করিয়া তাঁহার জাগ্রত প্রকাশ তৈয়ার করিবার জন্য তাঁহার এইরূপ প্রয়াস রহিয়াছে। ইহা সৃষ্টির রহস্যের ঘনিষ্ঠ একটি দিক। ইহার সংগে মানুষ ঘনিষ্ঠভাবে (উৎপ্রোতভাবে) জড়িত।

মানবীয় নফসের (প্রচলিত কথায় আত্মার) প্রতিষ্ঠাকল্পে বস্তু এবং বস্ত জগৎ পরিত্যাগ্য নহে বরং ইহা উপরেই নফসের (আত্মার) প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তি অর্জন করিতে হয়। কোরআনে সু-প্রতিষ্ঠাত নফসকে রূহ বলে। নফসকে রুহতে পরিণত করিতে কোরআনে সূরা কাফের ১২-১৪ নং আয়াতের মাওলা সদর উদ্দিন আহমদ চিশতীয় ব্যাখ্যা এখানে প্রাণিধান যোগ্য। (ক) রসূলগনের উপস্থিতি সকল যুগে এবং সকল দেশেই বিদ্যমান। রহস্য জগৎ হইতে সাহায্য প্রাপ্ত হইয়া মানুষ বস্তুর দাসত্ব হইতে মনকে মুক্ত করিয়া তুলিতে পারে। অর্থাৎ রসুলগনের নেক দৃষ্টি লাভ করিয়া বস্তুর কঠিন বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া আখিরাতে স্থান লাভ করিতে পারে। (খ) আর যাহার মুক্তি লাভ করিতে পারিবে না তাহাদিগকে তাহাদের অর্জিত তকদীর অনুযায়ী মৃত্যুর পর পূর্ণজীবন দান করিয়া জাহান্নামে ফেলিয়া দেওয়া হইবে। দুঃখের বিষয় রহস্যময় এই সত্য বিষয় ২টি সকল যুগের প্রায় সকল মানুষ ব্যপক ভাবে অস্বীকার করিয়া থাকে। যাহার ফলে মানুষ আধ্যাত্ববাদকে অস্বীকার করিয়া বস্তু বাদের মধ্যে জড়াইয়াছে ও উহাতে জড়িত থাকিতে ভালবাসে।
কোন বিষয়/কার্য্য/চিন্তা/অনুভূতি/দর্শন ইত্যাদি সপ্ত ইদ্রিয়ের মাধ্যমে যাহা মানব মস্তিকে আসে। তাহার কোনটাই মানবের জন্য নিষেধ নয়— যেহেতু তাহারা আল্লাহর আয়াত তথা আল্লাহর পরিচয় বহন করে। এই সকল বিষয় রাশি। মানুষ নামক সর্বশ্রেষ্ঠ জীবের মধ্যে ইহাদের আগমন অত্যাধিক। এই সকল বিষয় বাসনা মানুষকে সৃষ্টির সঙ্গে আটকাইয়া রাখে। গুরুর দেওয়া সালাতি কায়দায় এই সকল বিষয় রাশি গ্রহণ করিয়া উহার প্রতি কঠোর সালাত প্রয়োগ করিয়া যাকাতের মাধ্যমে মোহাকর্ষণ শূণ্যের কোঠায় পৌঁছাইয়া উহা উপভোগের কোন দোষ নাই। মানবজাতির মুক্তির জন্য একটি অমোঘকার্যকর ব্যবস্থা (চৎবংপৎরঢ়ঃরড়হ) মুর্শেদ কেবলা দয়াল বাবা শাহ সুফী সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী তাঁহার লেখা ঝঁৎধ ঋধঃরযধ ধহফ ঈড়হপবঢ়ঃ ড়ভ ঢ়ধহঃযবরংস নামক পুস্তকে লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মুদ রাসুল আল্লাহ এর ব্যাখ্যা আমাদেরকে সতর্কীকরণ মূলক আদেশ দান করিয়া লিখিয়াছেন। ঙনলবপঃং ড়ভ ঢ়ষবধংঁৎবং ড়ভ যঁসধহ ষরভব রহ ঃযব ঢ়যবহড়সবহধষ ড়িৎষফ ধৎব ধষষ ংঁমধৎ পড়ধঃবফ ঢ়ড়রংড়হ, রভ হড় ংধষধঃ রং ধঢ়ঢ়ষরবফ ড়হ ঃযড়ংব সধঃঃবৎং ড়ৎ ঢ়যবহড়সবহড়হ. সালাত প্রয়োগ করা ব্যতীত্ব সকল বিষয়ই হারাম। বিষয়ের উপর সালাত প্রয়োগ করিলে উহা হালাল এবং পরিনামে পবিত্র হইয়া যায়। মুক্তির স্তর হিসাবে মানুষ তিনটি স্তরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ১। জাহান্নাম, ২। জান্নাত, ৩। লামোকাম, জান্নাতের সর্ব উচ্চ স্তর আমাদের কাম্য। কারণ এই স্তরে তকদীর বা জন্ম চক্র আর থাকে না। এই স্তরে পৌঁছিতে হইলে সাধককে অবশ্যই তাহার ফানাফিল্লাহ ও বাকাবিল্লাহ স্তর অতিক্রম করিতে হইবে। ফানাফিল্লাহঃ- ফানাফিল্লাহর স্তরে নফস তাহার রবের (কামেল মুর্শেদের) ইচ্ছার মধ্যে এক প্রকার আতœহারা হইয়া থাকে; সুতরাং এই স্তরে আতœ চেতনা বা আমিত্ব থাকে না। অর্থ্যৎ সে তখন শুধু তাহার রবের দিকে আতœ ভূলা হইয়া আনুগত্যে লিপ্ত থাকে।
বাকাবিল্লাহঃ- বাকাবিল্লাহর স্তরে নফস আপন রবকে (কামেল মুর্শেদকে) নিজের মধ্যে পূর্ণভাবে অনুভব করিয়া জাগ্রতভাবে সর্বপ্রকার ভোগ এবং পরিপূর্ণ উপলদ্ধির মধ্যে থাকিবে এবং রবের দ্বারা আপন স্থায়িত অর্জন করিতে পারে। পরিশেষে বাক্বাত্ব অর্জনপূর্বক সৃষ্টির বন্ধন হইতে পরিপূর্ণভাবে/স্থায়ীভাবে সৃষ্টির বন্ধন হইতে মুক্তি লাভ করিতে সক্ষম।
বাক্বা= বে+ক্বাফ= বাক্বা, (আতিœক) শক্তির সহিত। শক্তিধর/ক্বাফগুণ সম্পূন্ন শক্তিধর। ডরঃয চড়বিৎ, অনংড়ৎনরহম ড়ভ ঃযব এৎবধঃ ঊসঢ়ঃরহবংং রহ ঃযব সরহফ ধহফ ঃড় ংঃধু রহ ঃযধঃ ঢ়ড়ংরঃরড়হ ঢ়বৎসধহবহঃষু. ফলত সকল বিষয়ের উপর গুরু দেওয়া সালাত পদ্ধতি প্রয়োগ করিয়া সকল বিষয়কেই অনু অনু করিয়া দৃশ্যমান পূর্বক মোহ ও মোহাকর্ষন পরিপূর্ণভাবে/স্থায়ীভাবে ত্যাগ বা যাকাত করিয়া মনে মহা শূণ্যভাব স্থায়ীভাবে ধারণ করিতে পারিলেই সাধক সিদ্ধি লাভ করিয়া ফানাফিল্লাহ ও বাকাবিল্লাহ অতিক্রম পূর্বক বাক্বাত্ব অর্জন এবং জাগ্রত নুরে মোহাম্মাদী সত্ব্যধিকারী অবস্থায় লামোকাম তথা মোকামে মাহমুদায় স্থায়ীভাবে দাখিল হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করিতে পারেন।

(এই প্রবন্ধটি মাওলা শাহ সুফী সদর উদ্দিন আহমদ চিশতীর লেখনী ও তাঁহার কথার প্রকাশ মাত্র)

Scroll to Top