স হো দ রা
মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম
( গল্পটির পটভূমি চার দশকেরও বেশ আগের। দেশে তখনও সামাজিক অবক্ষয় ছিল- অভাব দারিদ্রতা নৈতিক মূল্যবোধকে নির্বিচারে গ্রাস করতো। এমনই এক সময় ঘটনাক্রমে বস্তি প্রায় একটি মহল্লার বিভিন্ন শ্রেণির কিছু মানুষের সঙ্গে উঠবস করার সুযোগ হয়েছিল। তথাকথিত অধঃপতিত জীবনে নিপতিত সেই মানুষগুলোর মধ্যে যে সৌহার্দ সম্প্রীতি ও মানবিক মূল্যবোধের দৃষ্টান্ত দেখেছিলাম – আমাদের উচ্চবিত্তের মানুষ ও উন্নয়নশীল বর্তমান সময়ের সঙ্গে তার ব্যবধান অনেক। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত “সহোদরা” গল্পের মধ্যে দিয়ে অতীতের সেই সোনাঝরা দিনগুলোর কিছু চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। যে দূর্লভ অতীতকে আজও আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি – স্মরণ করি সেই সময়ের প্রিয়মুখ গুলোকে )
( প্রথম পর্ব )
দেখিতে দেখিতে কলেজ জীবনের ইতি টানিবার সময় হইয়া গেল । মাঝখানে আর মাত্র দু’টো মাস বাকি। তাহারপরই শেষ বর্ষের পরীক্ষা। সারাদিন ক্লাস সেমিনার বন্ধুবান্ধব খেলাধুলা আর পত্র পত্রিকার পিছনে সময় দিবার কারণে রাত্রিতে পড়া লেখার চাপটা অনেক বাড়িয়া গিয়াছে । এখন বেশ রাত্রি । কোন কিছুতেই মন বসিতেছে না। বই খাতা ফেলিয়া ঘর ছাড়িয়া খোলা আকাশের নীচে আসিয়া দাঁড়াইলাম। এই মধ্যরাত্রিতেও অলিগলি রাজপথ সরব। এইতো সবে প্রেক্ষাগৃহ ভাঙ্গিল । গেটম্যান বীরবল হল হইতে বাহির হইয়া আবছা চোখে আশ্রয় স্থলের দ্বারে আসিয়া খিস্তিখেউড় শুরু করিয়া দিল। বুড়ি কুন্তলা জাগিয়াই ছিল। দরজায় সোরগোল শুনিয়া সে ঘর হইতে তাড়িয়া আসিল। অতঃপর কড়া নাড়িয়া মঙ্গলীকে ডাকিয়া বীরবলের দিকে তর্জনী তুলিলঃ” হরি! হরি! তুই আজও নেশা করেছিস! এখনও তোর লাজ হলো না রে বেটা! বউয়ের গতরে কাপড় নাই -জঠরে দানা অন্ন নাই। নাকরি করে যা পাস -রোজ রোজ জহর গিলেতো সব হাওয়ায় উড়িয়ে দিস – তাতেই এতো বড়োনোকী ! ছিঃ ছিঃ মান গেলো। “
মঙ্গলী ঘুম হইতে উঠিয়া দরজা খুলিবার মাত্র তেলেবেগুনে জ্বলিয়া উঠিলঃ ” আজ আর কোন কথা নয়। রাত্তিরটা পার হোক – ভোরের ট্রেনে সোজা ঈশ্বরদী! দেখি কোন মরদে মোক ঠেকায়?”
বীরবল মুখে কুলুপ আঁটিয়া মাথা হেট করিয়া টলিতে টলিতে ঘরের ভিতরে ঢুকিয়া বলিলঃ ” খিরকী লাগা মঙ্গলী – খিরকী লাগা! ”
তাৎক্ষণিক অর্গল টানিবার ছোট্র একটা শব্দের সহিত সব ঝড় সব কোলাহল থামিয়া গেল । বীরবলের সহিত মঙ্গলীও নীরব হইয়া গেল। বুড়ি কুন্তলা হাসিতে হাসিতে বিড়িতে সুখটান মারিয়া আকাশের দিকে চোখ তুলিয়া হাঁক ছাড়িলঃ “রক্ষে কর গোপাল -রক্ষে কর। “
কুন্তলা মঙ্গলীকে এতোদিনে বেশ জানিয়াছে। ওর মুখের এমন প্রতিজ্ঞা সে ঢের শুনিয়াছে। সপ্তাহে সপ্তাহে তাহার পিতৃগৃহে যাইবার এ ছলটুকু সে প্রায়ই দেখিয়া আসিতেছে। বীরবলকে ঘুমন্ত অবস্থায় রাখিয়া মঙ্গলী ভোরের ট্রেন অনেকবার ধরিয়াছে – আবার সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরা পাখির মতো ঘরে ফিরিয়া ঠিকই উনুনে হাঁড়ি চাপাইয়াছে । কুন্তলা এইসব কীর্তি দেখিয়া শুধুই হাসিয়া মরে।
নিত্যদিনের মতো আজও ঘটনার সাক্ষী হইয়া সামনে হাঁটিতে লাগিলাম। বাহিরে কোজাগরী চাঁদ হাসিতেছে। হাসিতেছে উত্তর পাশের দীর্ঘ সরু খালটা। চাঁদের কিরণ জলের উপর পড়িয়া ইহা যেন রুপালী বন্যায় ভাসিতেছে। মুগ্ধ চিত্তে ধীর পায়ে খালের পাড়ে আসিয়া দাঁড়াইলাম। আমার মাথার উপর প্রকান্ড একটা আমগাছ। ইহার পশ্চিমে প্রাচীরের ওই পাশে সায়মাদের দ্বিতল ভবন। সায়মা এখনও ঘুমায় নাই। পড়া শেষে অর্ডিও ছাড়িয়া দিয়া একাকী বারান্দায় পায়চারী করিতেছে। গান শুনিতে শুনিতে ঘুম আসিলে তবেই বিছানার উদ্দেশ্যে পা বাড়াইবে। ঐ তো যন্ত্রটা সুরে সুরে বাজিতেছে; “কত নিশি গেছে নিদহারা ওগো কত ফুল গেছে ঝরে / বুঝি গো আমার সে কথাটি বলা হয়নি তেমন করে —-।”
সায়মা প্রতিরাত্রিতে এই গানের মধ্য দিয়া যেন নিজেকে খুঁজিয়া বেড়ায়। এ গান নহে – এ যেন ধ্যানমগ্ন নিশির করুণ বিলাপ ।
এইমাত্র স্টেশনে ঘন্টা বাঁজিল। তীব্র আলো ছড়াইয়া মধ্যরাত্রির ট্রেনটা দানবের মতো গর্জিয়া উঠিয়া বাহিরগোলা ছাড়িয়া বড়গোলা স্টেশনের দিকে ছুটিয়া চলিল। উহার গর্জনে যেন ঘুমন্ত রাত্রি আবার জাগিয়া উঠিল। জাগিয়া উঠিল পাড়া মহল্লা। ওপারের বাগদিপাড়ার কুকুরগুলো দল বাঁধিয়া তখন হইতেই বেসুরো কন্ঠে চিৎকার শুরু করিয়া দিয়াছে। পাশের গ্রাম দোয়াদবাড়ির জোয়ার্দারদের মোরগটাও নিশির নিঃস্তব্ধতা ভুলিয়া অবিরাম ডাকিয়া চলিয়াছে।
আমার দৃষ্টি এখন খালবিল নদীনালা অরণ্য ছাড়াইয়া অনেক দূরের একটি গ্রামে হারাইয়া গিয়াছে। হারাইয়া গিয়াছে স্বর্গ তুল্য অনন্তপুরে ।
অনন্তপুর ছাড়িয়াছি সেই চারবছর আগে । ছুটি’তে ছুটি’তে বছরে দুই একবার গ্রামে যাই। তাল তমাল হিজলের ছায়া ঘেরা নীড়ে কয়টা দিন কাটাইয়া আবার শহরের ব্যস্ততম জীবনে ফিরিয়া আসি। ফিরিয়া আসি এই বাহির গোলার খালের ধারে- বস্তি এলাকায়।
এখানে দুইটা ছাত্রাবাস। উহার দক্ষিণ পাশের রাস্তা ঘেষিয়া মিল কারখানা- দোকান পাট। উত্তর পাশে ঘিঞ্জির মাঝখানে ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর । কুন্তলা, বীরবল, মঙ্গলী বেশ কয়েক বছর হইল খাঁ সাহেবের করুণায় এখানে থিতু হইয়া আছে। কুন্তলা নিম্নবর্ণের পশ্চিমা হিন্দু- পেশায় ঝাড়ুদার। শহরের টকি হলে মাসিক ঠিকায় ঝাড় দেয়। নিঃসন্তান মঙ্গলীকে সাথে লইয়া ঝাটা বাল্তি হাতে রোজ সকালে কর্মস্থলে পা বাড়ায়। এই পেশাতেই কোন রকমে তাহাদের ছোট্ট সংসার চলিয়া যায়।
আমার কামরার পূর্ব জানালার ধারেই ছোট্ট একটা পুরাতন টিনের ঘর। সেইখানে কায়স্থ পরিবারের একজন বিধবার বাস । নাম বিরজা সুন্দরী। একদিন যমুনার ওপাড়ে তাহার বসতি ছিল। ফসল ভরা খামার ছিল। গোলা ভরা ধান ছিল। সুশ্রী দীর্ঘ কোমল দেহের মাঝে উল্লাস ছিল। বিরজা সিঁথিতে সিঁদুর লইয়া আরশিতে মুখ দেখিয়া নিজেকে ভাগ্যবতি মনে করিত। সর্বনাশী যমুনার করাল গ্রাসে তাহার সব চলিয়া গেল। যেদিন শোকে দুঃখে স্বামী শৈলেশ তাহার সিঁথির সিঁদুর মুছাইয়া দিয়া চিতায় উঠিল -সেদিন হইতে বিরজার অদৃষ্ট ধিকিধিকি করিয়া অনলে পুড়িতে লাগিল। next……….