শনিবার, রাত ১১:০৬, ১৬ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শনিবার, রাত ১১:০৬, ১৬ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ‘সুপারবাগ’ মোকাবিলায় নতুন ওষুধ উদ্ভাবনের চ্যালেঞ্জ

বর্তমানে এক নতুন ধরনের বিপদ ক্রমশ বাড়ছে, যা অ্যান্টিবায়োটিক–প্রতিরোধী ‘সুপারবাগ’ হিসেবে পরিচিত। এই ব্যাকটেরিয়া এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে, যে সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক তাদের বিরুদ্ধে কার্যকরী নয়। সুপারবাগগুলির কারণে রোগীদের চিকিৎসা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে, কারণ এদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নতুন ওষুধের প্রয়োজন। এর মধ্যে অনেক গবেষক ও বিজ্ঞানী কঠোর পরিশ্রম করছেন, নতুন ওষুধ উদ্ভাবনের জন্য, যাতে সুপারবাগের বিস্তার রোধ করা যায় এবং মানুষের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। তবে, এই লড়াইয়ে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক বাধাগুলির কারণে।

অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, যার ফলে অনেক রোগের চিকিৎসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এসব অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জীবাণুকে ‘সুপারবাগ’ বলা হচ্ছে।

চিকিৎসা বিষয়ক জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট’-এর গবেষণা অনুযায়ী, ২০২১ সালে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী সুপারবাগের কারণে বিশ্বে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ মানুষ মারা গেছেন। ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’ থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়া। ২০২২ সালের ল্যানসেটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলে প্রতি এক লাখ মৃত্যুর মধ্যে ২২টি সুপারবাগের কারণে হয়েছিল। ২০১৯ সালে, ভারতেই অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী সংক্রমণের কারণে প্রায় তিন লাখ মানুষ মারা গেছেন, যাদের মধ্যে ৬০ হাজারই নবজাতক।

বাংলাদেশেও ২০১৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) আইসিইউতে মারা যাওয়া রোগীদের ৮০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ ছিল সুপারবাগ।

তবে আশার কথা হচ্ছে, এখন কিছু নতুন ওষুধ তৈরি হচ্ছে যা সুপারবাগের বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারে। সম্প্রতি বিবিসির একটি প্রতিবেদনে সুপারবাগ ধ্বংস করতে সক্ষম এমন নতুন কিছু ওষুধ আবিষ্কারের খবর পাওয়া গেছে।

ভারতীয় কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার

চেন্নাইভিত্তিক অর্কিড ফার্মা একটি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করেছে যা ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ না করে, তার অ্যান্টিবায়োটিক-বিরোধী প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে। ‘এনমেটাজোব্যাকটাম’ নামের এই ওষুধ মূত্রনালির ইনফেকশন (ইউটিআই), নিউমোনিয়া এবং রক্তের সংক্রমণের মতো জটিল রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্বের ১৯টি দেশে এক হাজারেরও বেশি রোগীর ওপর পরীক্ষার পর এই ওষুধের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হয়েছে, এবং মার্কিন FDA ইতোমধ্যে এটি অনুমোদন দিয়েছে।

মুম্বাই-ভিত্তিক কোম্পানি ওকহার্ড ‘জাইনিচ’ নামে একটি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করছে, যা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সব সুপারবাগের বিরুদ্ধে কার্যকরী হতে পারে। ২৫ বছর গবেষণার পর তৈরি হওয়া এই ওষুধটি এখন তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে রয়েছে এবং আগামী বছর বাজারে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

এছাড়া, নাফিথ্রোমাইসিন নামক এক নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল চলছে। এটি ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া প্রতিরোধে ৯৭ শতাংশ সফল হয়েছে, যা বিদ্যমান চিকিৎসা পদ্ধতির তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর।

নতুন প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক

গ্লোবাল অ্যান্টিবায়োটিক রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ (জিএআরডিপি) এবং বায়োফার্মা প্রতিষ্ঠান বাগওয়ার্কস রিসার্চের যৌথ উদ্যোগে নতুন প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা হচ্ছে, যা গুরুতর ইনফেকশন নিরাময় করতে সক্ষম। তাদের একটি অ্যান্টিবায়োটিক বর্তমানে প্রাথমিক ধাপের ট্রায়ালে রয়েছে এবং এটি বাজারে আসতে ৫ থেকে ৮ বছর সময় লাগতে পারে।

জিএআরডিপি বর্তমানে হায়দরাবাদভিত্তিক অরিজিন ফার্মাসিউটিক্যাল সার্ভিসেসের সঙ্গে যৌথভাবে ‘জোলিফ্লডাসিন’ নামে একটি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করছে, যা গনোরিয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত হবে। এছাড়া, ‘সেফিডেরোকল’ নামের একটি অ্যান্টিবায়োটিকও বাজারে আসতে যাচ্ছে, যা মূত্রনালির ইনফেকশন ও নিউমোনিয়া চিকিৎসায় কার্যকরী এবং ইতোমধ্যে FDA অনুমোদন পেয়ে গেছে।

সতর্কতা

নতুন এসব ওষুধ কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে, তবে চিকিৎসকরা সতর্ক করে দিচ্ছেন। অ্যান্টিবায়োটিক শরীরের উপকারী ব্যাকটেরিয়াও ধ্বংস করে দেয়, ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধি পায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. কামিনী ওয়ালিয়া বলেন, ‘এই নতুন ওষুধগুলো নিয়ে আমি উচ্ছ্বসিত, তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আগের অ্যান্টিবায়োটিকগুলো যেভাবে অপব্যবহার করা হয়েছে, নতুন ওষুধগুলোও যদি অসতর্কভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে এগুলোর কার্যকারিতা খুব তাড়াতাড়ি কমে যাবে।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top