কেকা অধিকারী
আমেনা বেগমের ছোট বাড়িটার অবস্থান গ্রামের শেষ মাথায় যেখান থেকে বলা যায় ভুতিয়ার বিল শুরু। বাড়ি বলতে বিশ শতক জায়গার উপরে একটা গোলপাতার কুঁড়ে ঘর আর তার সামনে ঘন গাছ পালায় ঘেরা একটা ছোট্ট উঠান। ঘরের দরজার দুপাশের ডোয়ার সামনে একটা সাদা জবা ফুলের গাছ, কয়েকটা তুলশী আর গোটা তিনেক চুপুর গাছ আছে। চোখ পড়েলে সাদা ফুলে ভরা জবা গাছটা যে কোন মানুষের মন কাড়বেই কাড়বে। অবশ্য মানুষ সাধারণতঃ ওদিকটা মাড়ায় না বলে তা লোকচক্ষুর অগোচরেই থাকে। কিন্তু ভ্রমর আর প্রজাতির ওড়াউড়ি সব সময় থাকে ফুল গাছটিকে ঘিরে।
আমেনা বেগম মনে মনে গাছটির নাম দিয়েছে “বেওয়া সুন্দরী”। বছর পাঁচেক আগে হালদার বাড়ির জবা গাছ থেকে সে নিজেই একটা ডাল ভেঙে এনে ঘরের দরজার পাশে পুঁতে রেখেছিল – এমন বিধবা রঙের ফুল এ বাড়িতেই বেশি মানায় । বাড়ির অন্যান্য গাছ পালাও তার নিজের হাতে লাগানো। আর লাগাবেটাই বা কে? কেউ থাকলে তো? নিঃসন্তান আমেনা বেগম বিধবা হয়েছে তাও প্রায় বিশ বছর।
আমেনা বেগমকে গ্রামের লোকেরা কোনদিন নাম ধরে ডাকেনি। দশ, বারো বছর আগ পর্যন্ত তার নাম ছিল ‘রহমতের বউ’। মানুষের স্মৃতি থেকে রহমত মুছে গেছে সে বহুকাল। তাই তার নিজের নামও গেছে বদলে। লোকে এখন তাকে ডাকে ‘বাজা বুড়ি’ নামে। তার বাড়ির নাম হয়েছে ‘বাজা বুড়ির বাড়ি’।
বুড়ির দিন কাটে একা একা, রান্না-বান্না করে আর গাছ-পালা, কুকুর বিড়ালের সাথে কথা বলে। বিলে কাজ না থাকলে কেউ আর এ বাড়ির পথ মাড়ায় না। কালে ভদ্রে তার বাড়িতে কোন মানুষের পা পড়ে। তবে ম্যালা দূর থেকেও কোলের বাচ্চার মায়েরা আসে মাঝে মধ্যে। তারা আসে সন্তানের ঠান্ডা, কাশি, পেটের অসুখ সারানের জন্য তুলশী পাতা, বাসক পাতা, থানকুনি পাতা নিতে। আমেনা কারো বাড়িতে যায় না। বাজার সদায় লাগলে পাশের বাড়ির সম্পর্কীয় ভাসুরের ছেলেদের দিয়ে আনায়। চা পানি খাওয়ার জন্য ওদের হাতে পাঁচ, দশ টাকা গুঁজে দিলে ওরাও ‘না’ করে না। অবশ্য বেশি কিছু তো নয়, নুন, তেল, মসলার মতো সামান্য কিছু। কচিৎ কখনও হাটের মোহনচাঁদ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দু’টো ছানার সন্দেশ।
নতুন বউ হয়ে সে যখন এ গ্রামে এলো তখন পাড়া পড়শীদের বাড়িতে তার বেশ যাতায়াত ছিল। আস্তে আস্তে সে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। বিয়ের পাঁচ-ছয় বছর পার হলেও তার যখন সন্তান হচ্ছিল না তখন আস্তে আস্তে সে নিজেই নিজেকে বাড়ির মধ্যে বন্দী করে ফেলেছে। বাজা নারীর মুখ দিনের আরম্ভে কাউকে দর্শন করাতে নেই, কোন শুভ কাজে তাকে থাকতে নেই। আমেনা মানুষের দিন খারাপ করতে চায়নি, শুভকাজে অমঙ্গল আনতে চায়নি। তারচেয়ে বড় কথা কোন পোয়াতি নারীর স্ফীত উদর দেখলে, কোন কোলের শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খেতে দেখলে তার নিজেরই কেমন পাগল পাগল লাগতো। তাই সে বাড়ির কাজেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে সব সময়।
অবশ্য কেউ তার বাড়িতে এলে সে বাড়ির ফলটা, মূলটা দিয়ে আপ্যায়ন করে। তাকে ধরে রাখতে চায় যতোটা সময় পারে। মানুষ মানুষের সঙ্গ ছাড়া কতক্ষণ একা বাঁচতে পারে ? তবে তার মিষ্টি কথা, ফলমূল, তরকারি খুব একটা কাজে দেয় না। আগতরা বেশি দেরী না করে ওসব হাতে নিয়ে যার যার বাড়ির পথ ধরে। ইদানিং তার দিন কাটলেও রাত মোটে কাটতে চায় না। এভাবে কী শীতে কী গ্রীষ্মে একাকীত্ব আমেনাকে জাপটে ধরে শীতকালে গোসল শেষের ভেজা কাপড়ের মতো। এমন কি ভাদ্রের তালপাকা গরমে অসহ্য আমেনা বেগম যখন ব্লাউজ খুলে দাওয়ায় বসে নিজেকে ঠান্ডা করতে চায় তখনও তার মৃত মানুষের মতো শীতল ভেতরটা একটু উষ্ণতার জন্য হাহাকার করে৷
অথচ আমেনা বেগমের নারী দেহের তাপ মিইয়ে গেছে বহুকাল। সে ছিল রহমতের দ্বিতীয় বউ। প্রথম বাচ্চা জন্ম দিয়ে রহমতের প্রথম বউ মারা যায়। শুনেছে মা-হারা বাচ্চাটা বেঁচে ছিল মাত্র কয়েকদিন। বিয়ের পর অনেকগুলো বছর রহমতের সঙ্গ করেও তার যখন গর্ভ হল না তখন সে বুঝে গিয়েছিল তার নিজেরই মা হওয়ার ক্ষমতা নাই। সেই থেকে শারীরিক সম্পর্কে আকর্ষণ নেই তার। আর এখন তো আমেনা বেগম এক পা কবরে দিয়ে বসে আছে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে হিন্দু পাড়ার মণিময় দাশ ছোট একটা জাল নিয়ে আমেনার বাড়ির পাশের বিলে মাছ ধরে। পথ কমাতে মাঝে মাঝে সে তার বাড়ির উপর দিয়ে বিলে যায়। উঠতি বয়সের যুবক মণিময় প্রায়ই উচ্চ স্বরে সিনেমার কোন চটুল গানের কলি ভাজতে ভাজতে পথ চলে। কখনো বা তাকে দেখলে হাঁক ছাড়ে, “ও বুড়ি, কেমন আছো?” কিংবা “ও বুড়ি, কী কর?”
কদিন আগে আমেনা তার নিচু ছাউনির পাটখড়ির বেড়ার রান্না ঘরে বসে চুলার মুখে লাকড়ি গুঁজছিল। এমন সময় মণিময়ের ডাক
– ও বুড়ি, কী রান্না কর?
– তুই এসে দেখে যা।
কী মনে করে মণিময় সেদিন আমেনার রান্না ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। চুলার উপর বসানো হাড়ির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
– এটা কী?
– চুপুরের টক। সরিষার ফোঁড়ন দিছি। একটু গুড়ও দিছি। ভাত খাওয়ার পরে মুখটা কেমন যেন লাগে। কী যেন খাইতে মন চায়। টক মিষ্টি কিছু মুখে দিলে ভালো লাগে। ঐ দেখ ঘরের সামনে চুপুর হইছে। লাল লাল ঊর্ধমূখী ফলে ভরা গাছগুলো আঙুল দিয়ে দেখায় সে। চুলা থেকে জলন্ত কাঠটি টেনে বের করে মালসার পানিতে নিভিয়ে রেখে আমেনা বেগম উঠে দাঁড়ায়। মণিময়কে বলে,
– তুই একটু দাঁড়া। তোরে গেলাসে করে একটু দেই। এক দৌঁড়ে ঘর থেকে একটা কাঁচের গ্লাস এনে নারকেলের আইচার চামচ দিয়ে হাড়ি থেকে টক তুলে গ্লাসে ঢালে আমেনা।
– সাবধানে ধর। অনেক গরম। জুড়ালে পরে খা।
আমেনা মণিময়ের দিকে উঁচু পিড়িটা ঠেলে দেয়। মণিময় পিড়িতে বসে গ্লাসে ফুঁ দিতে দিতে বলে
– তোমার টকের রঙ তো দেখি ম্যালা সুন্দর! তোমার মতো টকটকা। স্বাদটাও তো মারাত্মক।
মণিময় রসিয়ে রসিয়ে টক খায়। তার ফাঁকে আমেনা বেগমের নানান প্রশ্নের টুকটাক উত্তর দেয়।
লম্বা চুমুকে সবটুকু তরল মুখে টেনে নিয়ে গ্লাসটা চুলার পাশে রেখে মণিময় উঠে দাঁড়ায়। তার সাথে আমেনা বেগমও দাঁড়িয়ে যায়। মণিময় ডান হাতটি আমেনা বেগমের গলার পিছন দিক থেকে নিয়ে তার ডান কাঁধে রাখে
– বুড়ি, তুমি তো বেজায় মজার একটা জিনিস খাওয়াইলা। এর লোভে তো রোজ তোমার বাড়িতে হানা দিতে হবে।
– তুই রোজই আসিস।
– আচ্ছা যাই। দেখি যদি কিছু মাছ পাই।
মণিময়ের যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে থাকে আমেনা।
এ ভাবে প্রায় প্রতিদিন মণিময় আমেনা বেগমের রান্না ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। বুড়ি কোনদিন তাকে চুপুরের টক, কোনদিন লেবু পাতা দিয়ে তেঁতুলের টক, কোনদিন আমের ফলসির টক খাইয়েছে। যেদিন টক খাওয়াতে না পেরেছে সেদিন তার সামনে দিয়েছে বারোমাসি পেয়ারা, টক মিষ্টি বড়ই নয়তো পাঁকা পেঁপে।
রাতজাগা আমেনা দিনের আলোর অপেক্ষা করে আর ভোরবেলার আমেনা অপেক্ষা করে মণিময়ের। এতদিনে সে যেন করার মতো একটা জরুরি কাজ পেয়েছে। নিজের খাওয়া নিয়ে চিন্তা করায় তার অভক্তি। কিছু একটা খেয়ে দিন পার করতো সে। হঠাৎ খুব ইচ্ছে হলে নিজের মন মতো কিছু রাঁধা হতো তার। এখন কারও জন্য কিছু করার তাগিদে দিনগুলো তার বেশ কেটে যাচ্ছে। যদি মণিময়ের আসা, যাওয়া, খাওয়া সব মিলিয়ে বড় জোর আধা ঘন্টার বিষয়, তবুও একটুই আমেনার দিনকে বদলে দিয়েছে।
খুব ভালো লাগে আমেনার যখন মণিময় তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “বুড়ি, তোমার হাতে জাদু আছে “।
কিংবা তিন আঙুলে তার থুতনি নাড়িয়ে দিয়ে বলে, “ও বুড়ি, এই টক খাওয়াইয়া বুঝি বুড়োকে আজীবন বসে রাখছিলা?”
মণিময় চলে গেলেও আমেনার মনটা কী একটা আনন্দে ভরে থাকে। মণিময়ের একটু ছোঁয়া, ক্ষণিকের একটু আলিঙ্গনের উষ্ণতা সারাদিন তার অনুভবে থাকে। আমেনা অতীত হাতড়ায় – মণিময়রে বাদ দিলে শেষ কবে কোন মানুষ আমারে ধরেছে? শেষ কবে কেউ আমাকে জড়াইয়া ধরছে? আমার হাত দুইটা কেউ নিজের দুহাতের মুঠোয় নিছে? আমার মাথায় হাত রাখছে? আমিই বা শেষ কোনদিন কাকে বুকে তুলে নিছি? জড়াইয়া ধরছি? জ্বর কপালে হাত রাখছি? কিছুই সে মনে করতে পারে না। পৃথিবীতে এতো হাজার কোটি মানুষ। কিন্তু একজন মানুষ তার কোথায়ও নেই যে আমেনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে একটু উষ্ণতা দিতে পারে।
গাছের অল্প কয়টা চুপুরের দিকে চেয়ে আমেনা বেগম ভাবে যে, সব কটা দিয়ে একদিন টক রেধে ফেলবে। ওগুলো না খেলে ফলগুলো শক্ত হয়ে যাবে। পরদিন সকালে তার টক রান্না হলে পর চুলায় ভাত চড়ায়। ভাতে একটা ডিম ও দুটা আলু সিদ্ধ দিয়ে দেয়। আজ আর কিছু রাধবে না। তার শরীরটা ভালো লাগছে না। ভেবেছিল বছরের শেষ চুপুরের টকটা মণিময়কেও খাওয়াবে। কিন্তু মনিময় আজ আর এলো না। আমেনা বেগম রান্নাঘরে ভাত, টক গুছিয়ে রেখে বিছানায় গিয়ে শুয়ে রইল।
দুপুর গাড়িয়ে গেছে কখন। এমন সময় দরজায় মণিময়ের ডাক,
-ও বুড়ি কই গেলা?
আমেনা বেগম ধরপরাইয়া বিছানা ছেড়ে নেমে আসে।
– আমি তো ভাবলাম আজ বুঝি তুই মাছ ধরতে যাবি না।
– আজকে কী সব ভাবতে ভাবতে রাস্তা দিয়া কখন যেন বিলের কাছে চইল্যা গেছিলাম।
আমেনা বেগম দৌঁড়ে গিয়ে মণিময়ের জন্য টকের গ্লাস নিয়ে আসে।
-দুপুর গড়াইয়া গেছে। আলু ডিম ভর্তা দিয়ে একটু ভাত খা বরং।
– না, না, বাড়িতে গিয়াই ভাত খামু। তোমার একলার ভাত আমি খাইলে তুমি খাইবা কী? আমারে তুমি টকই দাও। ভাত পাওয়া যায় সবখানে। এই টক পাওয়া যায় না।
ঠান্ডা টক মণিময় এক চুমুকে খেয়ে নিয়ে গ্লাসটা ফিরিয়ে দিতে দিতে বলে –
– বাড়ি চলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো তোমাকে কথাটা জানাইয়া যাই।
মণিময় আমেনা বেগমের চোখের দিকে চেয়ে বলে
– বুড়ি, কালকে সকালের বাসে আমি যশোর যাইতেছি। ছোট কাকার স’মিলে কাজ করমু। আর গ্রামে থাকমু না। এইখানে থাইক্যা কী করমু কও?
মণিময় কথা থামিয়ে আমেনা বেগমের দিকে চেয়ে থাকে উত্তরের আশায়।
– তাই তো। – এটুকু বলে আমেনা বেগম অন্য দিকে মুখ ঘুরায়। স্তব্ধতা চারিদিকে। অসহ্য স্তব্ধতাকে ভেঙে দিতে যেন মণিময় একটু জোরেই বলে ওঠে
– আরে দেখ যেজন্য তোমার কাছে আসছি সেইটাই তো মনে নাই। আজকে একটা বড় শিং মাছ পাইছি।
মণিময় খলুইয়ের ভিতর থেকে শিং মাছটা বের করে এনে মাটিতে রাখে।
– ভাবলাম মাছটা তোমারে দিয়া যাই। তুমি রাখ। ঝোল রান্না কইরা খাইও। এখন রান্ধ। না হয় জিয়াইয়া রাখ। কাইল রাইন্ধো।
আমেনা বেগম মাছটার দিকে তাকায়।
– না রে। ও মাছ তুই বাড়ি নিয়া যা। আমার আর আজকাল মাছ, মাংস খাইতে মন চায় না।
স্তব্ধতা কাটে না। মণিময় মাছটা তুলে খালুইতে ভরে। আস্তে করে বলে
– আমি তাইলে যাই।
হাতে খালুই আর কাঁধে জাল নিয়ে মণিময় কখন বাড়ির সীমানা পেরিয়ে যায় আমেনা বেগম দেখতে পায় না।
আমেনার ভীষণ শীত লাগছে এখন। হাত, পা, পেটে, বুকে যেন তার জমাট বরফ। মনে হচ্ছে চারিদিকে নিকশ অন্ধকার। আন্দাজে সে কোনমতে বিছানায় এসে বসে। মাথাটায় ভীষন যন্ত্রণা হচ্ছে। কম্বলটা টেনে নিতে হাত বাড়ায়। এরই মধ্যে নাক, মুখ দিয়ে তার রক্তের স্রোত নামে। বালিশে মাথা এলিয়ে দিতে দিতে বহুবছর পর সে যেন নিজের বুকে উষ্ণতা অনুভব কর। আমেনা বেগমের বন্ধ চোখ দেখতে পায় তার সাদা জবা ফুলগুলো ধীরে ধীরে রক্ত জবা হয়ে গেছে। রক্ত জবা ফুলগুলো সব অবশেষে একে একে এসে তার বুকে জড় হয়।
পরদিন ভোরে আমেনা বেগমের বুকে ফুটে থাকা লাল জবায় ভ্রমর নয়, কয়েকটি বড় মাছি ভনভন্ করতে থাকে। ঠিক তখন গাঁয়ের পাশ দিয়ে হর্ণ বাজিয়ে মণিময়ের বাস যশোরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।