ডায়েরি থেকে আত্মকথা
মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম
আমাদের স্বনামধন্য নাট্যকার স্বর্গীয় সুনীল কুমার বর্মণ এই জ্ঞানদা মাসীর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করে দিয়েছিলো। সুনীল আগা গোড়াই তাকে মা বলতো। প্রথম প্রথম আমি তাকে মাসীই বলতাম। মাসীর জ্ঞানের প্রাচুর্য দেখে এবং তার স্নেহে ধন্য হয়ে একসময় আমিও তাকে মা বলতে বাধ্য হলাম। কালো বর্ণের একহারা গড়নের এই বয়স্কা বিধবা রেল স্টেশন সংলগ্ন দক্ষিণ পাশের একটা ঘিঞ্জি মতো বাড়িতে দোচালা টিনের ঘরে থাকতেন। তিনি ছিলেন একজন পশ্চিমা হিন্দু। নিজেদের মধ্যে ভোজপুরী ভাষায় কথা বললেও আমাদের সঙ্গে স্পষ্ট বাংলা বলতেন। রেল কতৃপক্ষের আনুগত্যে কর্মসূত্রে স্বামীর সঙ্গে এখানে এসে আশ্রয় নেন। স্বামী লাল বিহারীকে স্টেশনের সবাই লালজ্বী বলে ডাকতো। কেউ ডাকতো রবী শঙ্কর। শুধু রবী নামেও অনেকে তাকে বেশি চিনতো। এই স্টেশনের বেশ কিছু দায়ীত্ব তার উপর অর্পিত ছিল। স্টেশনের ল্যাম্প পোস্টে সন্ধ্যায় বাতি দিয়ে আসা, স্টেশন মাস্টারের কক্ষ, টিকিট কাউন্টার থেকে শুরু করে ওয়েটিং রুম গুলোতে হ্যাজাক ধরানো, সময় মতো ট্রেনের ঘন্টা বাজানো ছাড়াও মালগাড়ির পন্যসামগ্রী খালাস হলে গোডাউনে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তার জন্য নির্ধারিত ছিলো। জ্ঞানদা দাসীও ঘরের কোণে বসে থাকতেন না। বয়স কালে ভোরে উঠে আগে পূজা অর্চনা সেরে নিতেন। অতঃপর প্লাটফর্মে ভীড় পড়ার আগেই মাথায় ঘোমটা টেনে কোমরে আঁচল জড়িয়ে ঝাঁটা হাতে কাজে নামতেন। ওয়েটিং রুম থেকে শুরু করে বড় বাবুর কামরা পর্যন্ত পরিস্কার করে আবার ঘরে ফিরতেন। বাকি সময় সংসারের কাজকর্ম সেরে ভজন সাধনে মগ্ন হয়ে পড়তেন। নিঃসন্তান লালজ্বী দেহ ত্যাগ করার পর রেল কতৃপক্ষের দয়া দাক্ষিন্যে জ্ঞানদা দাসী এখানেই বহাল তবিয়তে রয়ে যান। বয়স ভারির সাথে আগের পেশা থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে নিজের পরিচয়টাও বদলে ফেলেন। মন্দির আখড়ায় সময় কাটিয়ে সবার প্রিয় গোসাই মা হয়ে ওঠেন। গীতা রামায়ন মহাভারতের উদ্ধৃতি ছাড়াও তিনি সকল ধর্মের উপর অগাধ জ্ঞান রাখতেন। তার কাছে সবচেয়ে বড় ছিল মানব ধর্ম। তাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার কাছেই তিনি শ্রদ্ধার পাত্রী হয়ে উঠেছিলেন। তার মানবতা বোধ মাঝে মাঝে আমাকে তার দোচালা ঘরের বারান্দায় টেনে নিয়ে যেতো। আমার এখানে আসার পথটাও বর্মনই তাকে চিনিয়েছিল। শেফালীসম শ্বেত শুভ্র বসন পরিহিত জ্ঞানদা দাসী আলাপনের ইত্যবসরে একটা মাত্র চা’তেই সন্তোষ্ট চিত্তে আপন গৃহে ফিরে যেতেন। অন্তর খোলা মানুষটা নামের শেষে দাসী শব্দ উচ্চারণ করে গৌরব বোধ করে বলতেন; ” জগৎ সংসারে কে দাসী নয়! সবাই মহাপ্রভুর খেদমতের দাস। আমি তারই সেবা দাসী। ” তার দোচালা ঘরের খোলা বারান্দায় বসে কথা বলতে বলতে অনেকদিন বেশ রাত হয়ে যেতো। আগ রাত্রির ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতাম। অতঃপর ভট্রকাওয়াক খালিয়াপাড়া হয়ে আঁকাবাঁকা সরুপথ ধরে ঘরে ফিরতাম। পথ চলতে তার আদর্শের, তার মানবতা, সততা আর জীবন দর্শনের কথাগুলো বড় বেশি বুকে বাঁজতো। জ্ঞানদা দাসী অনেক আগেই ইহধাম ত্যাগ করেছেন। “বাতিওয়ালা” গল্পটা লিখতে নিয়ে আজ বারবার তাকে মনে পড়ছে। মনে পড়ছে তার একটা দিনের সেই প্রশ্নটার কথা। ভক্তদের উদ্দেশ্যেই তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন। সেদিন হক বেহক, হারাম হালাল নিয়ে কথা হচ্ছিল । তিনি অনেক ভূমিকা টানার পর বললেন; ” মনে করো তুমি তোমার টাকা দিয়ে বড় একটা পাউরুটি কিনেছো। সেটা বেঞ্চে বসে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছ। এমন সময় একটা কুকুর এসে ছোবল দিয়ে অর্ধেক খেয়ে ফেললো। বাকি টুকু তোমরা কী করবে? ” উত্তর দিলামঃ ” ফেলে দিবো। ” জ্ঞানদা হাসলেনঃ ” কেন, তোমার টাকায় ক্রয়কৃত হক তুমি ছেড়ে দিবে কেন? ” “কুকুর নিকৃষ্ট জীব। সে কোনকিছু স্পর্শ করলে তা হারাম হয়ে যায়। হারাম দ্রব্য মানুষের জন্য ভক্ষণ যোগ্য নয়। ” ” হ্যাঁ। ঠিক বলেছ। শুধু কুকুরের প্রতি নয়। কুকুর ছোঁয়া দ্রব্যটার প্রতিই মানুষের ঘৃনা এসে যায়। আমাদের সংসার বিরাগী হওয়ার কারণ ঐ একটাই। হারাম অবৈধ সম্পদ ভক্ষণকারী যখন জোর করে কারো বিষয় সম্পত্তি হস্তগত করে নেয়। তখন সেও কুকুরের মতো ঘৃণিত জীব হয়ে যায়। কোন সৎ সাধুজন চায় না তার সামনে দাঁড়াতে। তার প্রতি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। একসময় ঐ বিষয় সম্পদের প্রতি তার অবজ্ঞাও এসে যায়। নির্লোভ নির্মোহ জীবন তখন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। আমিও সংসারের পাপীষ্ঠদের জ্বালায় একদিন সেই ডাক শুনেছিলাম। ” মা জ্ঞানদা দাসীকে সেদিন আর কোন প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করেনি। সারা পথ চলতে চলতে কেবল নিজের আত্মার কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম; ” তাহলে বিধাতা কাকে বর দিয়েছেন? ঐ নির্লোভ নির্মোহ পূণ্যবানদের না জগৎ সংসারের স্বার্থপর অত্যাচারী অসুরদের? ” ঢাকা
৯ / ১২ / ২০২৪