রুমা চৌধুরী
আজ বাদলের রাত, সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি। রাত যত ভারি বৃষ্টি ততোই বেশী।বর্ষা রাতের বৃষ্টি বেশীর ভাগ এমনি হয়।আমি আর রেদোয়ান যে খাটে শুয়ে আছি তার পাশের জানালা টার একটা পাট খোলা।ঠান্ডায় ভালো ঘুম হয়েছে।হঠাৎ হিমেল হাওয়ার সাথে, অসাধারণ সুন্দর গন্ধে পুরো ঘর মৌ মৌ করছে। ঝিরিঝিরি করে পানি এসে আমার গায়ে লাগছে। রেদোয়ান চাদর মুরি দিয়ে আছে, ও হয়তো বুঝতে পারছে না পানির ব্যাপারটি। তাহলে অনেক আগেই জানালা বন্ধ করে দিত।আমি জানালার আরেকটি পাট খুলে দিলাম।সুবাস এর বন্যা বয়ে গেল। এতো মিষ্টি গন্ধ কোথা থেকে আসছে। হঠাৎ মনে পরলো,২০০ গজ দূরেই তো একটা কদম গাছ আছে। ওখান থেকেই আসছে। ইচ্ছে হচ্ছে বারান্দায় যাই,আর কদম গাছ কে প্রাণ ভরে দেখি।এতো সুন্দর সুবাস যে এনেছে তাকে দেখবো না!রেদোয়ান কে ডাকার প্রচন্ড ইচ্ছে হলো আমার। কিন্তু ও কখনোই আমার হাত ধরে বারান্দায় দাঁড়াবে না। দেখবে না প্রকৃতির অঢেল সৌন্দর্য। রেদোয়ান এমন কেন! আমার ভালো লাগা গুলো বুঝতে চায় না। খুব শক্ত মনের মানুষ ও।আর ওর মা, মানে আমার শাশুড়ী সেতো মনে হয় আকাশ দেখেননি বহুদিন। চার দেয়ালের মাঝে বন্দী থাকা তার ভীষণ পছন্দ।আমাকেও রাখতে চায় তার মতো করে।কিন্তু আমি দেখতে চাই খোলা আকাশ সবুজ দিগন্ত । দেখতে চাই ধানের শীষের উড়ে বেড়ানো লাল ফড়িং এর নাচ।ওদের বাড়িটা এক তলা, কিন্তু অনেক বড়।ছাদের এক কোণে একটা রুম আছে।ওটা সবসময় তালা বন্ধ থাকে। কিন্তু আমার প্রচন্ড ইচ্ছা ওই ঘর খুলে দেখার। একদিন ভয়ে ভয়ে মাকে বললাম, মা ওই ঘরে কী আছে?সে চোখ মুখ কুঁচকে বলল,কেন তুমি দেখবে, দেখার ইচ্ছা। আমি বললাম না, এমনি বললাম। ছাদে যেতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু মাঝে মাঝে ভয়ে গা ছোপ ছোপ করে।এতো বড় বাড়ী মা, আমি, রেদোয়ান আর কাজের মেয়ে টুনি, এই চার জন থাকি তো তাই মনে হয় এমন লাগে। কে যেন দরজায় শব্দ করছে।হয়তো, মা হবে।যাই খুলে দিই।
– নীলা ও নীলা!
মাই তো, আমি দরজা খুলে দিলাম।
মা রাগী গলায় বলল,
– নীলা তুমি বৃষ্টির দিনে জানালা খুলে দিয়েছ,বন্ধ কর।তোমাকে না বলেছি এইদিকের জানালা খুলবে না। রেদোয়ান তুমি দেখনা এ গুলো। – মা তুমি যাও আমি দেখছি।
আমি গুটি গুটি পায়ে জানালা বন্ধ করলাম.!
মা কার সাথে কথা বলল এত সময় নিয়ে!টুনিও দেখি ঘর গোছানো নিয়ে ব্যস্ত।যাই মার কাছে গিয়ে শুনি।মা আপনাকে কি এক কাপ চা দিব?
-হুম..দাও।তার আগে আমার কথা শোন মনোযোগ দিয়ে, তোমার শশুরের ছোট বোন মানে তোমার ছোট ফুপু তোমাকে দেখার জন্য কাল ঢাকা থেকে এখানে আসছে। তোমার বিয়েতে আসতে পারেনি,ও তখন দেশের বাইরে ছিল। তাই এখন দেখতে আসবে।আদর যত্ন করবে। তবে শোন ও একটু ঠোঁট কাটা স্বভাবের, পেটে কথা রাখতে পারে না বানিয়ে ছানিয়ে বলে দেয়।তুমি একটু ভেবে চিন্তে চলবে।
– ঠিক আছে মা,তাই হবে।
– যাও তোমার ফুপুর ঘরে যাও,ফুলের ব্যবস্থা কর।ও ফুল ভালোবাসে।
সারা বাড়ি সুন্দর করে গোছানো হলো।সব ঘরের থেকে ফুপুর ঘরটা একটু আলাদা লাগছে। মনে হয় ফুলের জন্য।
রেদোয়ান এর আসতে আজ একটু দেরি হবে। ব্যাংকের চাকরি সারাক্ষণ হিসাব নিকাশ।
সকাল ১০ টার দিকে ফুপু পৌঁছে গেল আমাদের বাড়িতে।বারান্দা দিয়ে দেখলাম অনেক সুন্দর একজন মহিলা গাড়ি থেকে নামছে।বাহ্ ফুপু তে দেখতে অনেক চমৎকার। আমি এগিয়ে গেলাম পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেই ফুপু বলল,
– তুমি নীলা!
– জ্বি ফুপু আমি নীলা।
মা সিড়িতে দাড়িয়ে বলল,
– শাহনাজ কেমন আছ?
– ভালো আছি, তুমি ভালো আছ তো ভাবি।তোমার ছেলের বউ তো সুন্দর হয়েছে।
ফুপুর জন্য আমি খাবার রেডি করতে গেলাম।মা ফুপুর রুমে ফুপুর সাথে গল্প করছে।মাকে এত সুন্দর করে গল্প করতে আগে কখনো দেখিনি। ফুপু আমার সাখেও খেতে খেতে অনেক গল্প করলো।সে বলল,-তোমাদের বাড়ির ছাদটা কিন্তু খুব সুন্দর, চারদিকে গাছ।গাছে চেনা অচেনা নানা রকমের পাখি। তোমাকে নিয়ে সন্ধ্যার পর ছাদে যাব।
-ফুপু,আপনার রুমে গিয়ে একটু রেস্ট করেন, অনেকটা পথ এসেছেন।
– না না আমি তোমাদের সারা বাড়ি ঘুরে দেখবো।ভাইজানের হাতের কত জিনিস আছে এখানে।
আবার কালকেই ফিরতে হবে, তোমার ফুপা আবার একা থাকতে পছন্দ করেনা।রেদোয়ান কখন আসবে আজ একটু রাত হবে বলেছে।ও আচ্ছা নীলাা দাড়াও তোমার জন্য একটা শাড়ী এনেছি।তুমি এটা আজ পরবে।
কেউ আমাকে উপহার দিলে আমার খুব ভালো লাগে।
খুশি খুশি মনে ঘরে এলাম।ফুপুর শাড়ীটা কিন্তু অনেক সুন্দর, নীল রঙ।নীল শাড়ী পরলে নিজেকে, নীলঅপরাজিতার মত মনে হয়।আজ সারাদিন মেঘ মেঘ আবহাওয়া। সন্ধ্যায় ফুপু আমার ঘরে এলো।তাকে নিয়ে ছাদে গেলাম।ছাদে ঠান্ডা একটা হাওয়া বইছে।ফুপু আমার দিকে চেয়ে হাসি হাসি মুখে বললো নীলা,তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে নীল আকাশের এক টুকরো মেঘ আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে।সত্যি অপুর্ব লাগছে নীল শাড়ীতে তোমায়।কেন জানি বার বার আমার মনে হচ্ছে, ফুপু হয়তো এই ঘরে রহস্য জানে
তাকে আমি জিজ্ঞেস করবো।আমি সত্যি জিজ্ঞেস করে ফেললাম।
ফুপু এই ঘরে কি আছে।?
ফুপু অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে।,তার পর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললো,এত সুন্দর নিস্পাপ মুখ খানা তোমার, কি করে মিথ্য আমি বলি।আজ সব সত্য কথা বলবো তোমাকে।সব সত্য শুনেও তুমি রেদোয়ানকে ভালোবাসতে পারবে,এ আমি প্রথম দেখাতে বুঝতে পেরেছি।চলো ঐ কোনাটাতে দাড়াই। তোমার শশুর যখন মারা যায়।তখন রেদোয়ান পড়াশুনার জন্যবাহিরে থাকতো।তোমার শাশুড়ী একা হয়ে পরবে তাই আমাদের এক দুরসম্পর্কে চাচাতোবনের মেয়েকে নিয়ে আসলো।আমাদের বোনটার দিনাজপুরের বিয়ে হয়েছিলো।অর্থনীতিক আবস্হা খুব একটা ভালো ছিলো না ওর। তবে মেয়েটা খুব সুন্দরী ছিলো,নাম টগর। তোমার শাশুড়ী বলেছিল কিছু দিন টগরকে তার কাছে রেখে,তার পর ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেবে।এর মধযে রেদোয়ানকে বিয়ে দিয়ে বউ আনবে।কিন্তু সেটা আর হলোনা।টগরের সাথে ধীরে ধীরে রেদোয়ানের একটা সম্পর্ক হয়ে গেলো।আমি শুনেছি ভালোবাসার সম্পর্ক এত গভীরে গিয়েছিলো,যে টগর মা হতে চলেছিলো।নীলা আমি জানি তুমি অনেক বড় মনের মানুষ। তবু ও বলছি এই পৃথিবীতে এমন অনেক বড় বড় দুঃখের শেষে ছোটো ছোট শান্তি রয়ে যায় তুমি সেই শান্তির টুকরো গুলো এক জায়গায় করবে।
ফুপু তার পরের টুকু বলো।আমি তোমাকে তুমি বলে ফেলেছি।কারন আমার মনে হচ্ছে পৃথিবীতে তুমি আমার বড় আপন জন।
তোমার শাশুড়ি ব্যাপারটাকে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেনি।আর রেদোয়ান তো র্নিবাক। নিজের অসহায়ত্বের কাছে হার মেনে,টগর এই ঘরেই জীবনের ইতি টেনেছিলো।তাই চারদেয়ালের মধ্যে সত্যকে বন্ধকরে রাখার চেষ্টা।
সমাজের মুখ বন্ধ করার জন্য মোটা অংকের টাকা ছিটিয়েছে তোমার শাশুড়ি। নীলা তোমার কি মনটা বেশী খারাপ। না ফৃুপু আমি ঠিক আছি।কাজের মেয়ে টুনি ছাদে এসেছে ফুপুুকে ডাকতে। মা জানি কি কথা বাতরা বলবে।আমি ফুপুকে বললাম ফুপু আপনি নিচে যান,আমি আর একটু থাকবো।
আকাশের মেঘটা একটু ভারি হয়ে আসছে।
হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই অঝোরে ঝরবে। আমার চোখের নোনা জল মিশে যাবে বর্ষার জলের সাথে,হয়তো কেউ জানবেই না।
( সমাপ্ত)