শনিবার, দুপুর ১২:১৩, ১৬ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শনিবার, দুপুর ১২:১৩, ১৬ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কোরান দর্শন

সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী

সূরা ইয়া সিন এর ব্যাখ্যা

৭৪ — ৭৬ : ‘ মিন দুনিল্লাহে আলেহাতান ‘ ইহার অর্থ সাধারণত লেখা হইয়া থাকে ‘আল্লাহর পরিবর্তে অন্য ইলাহসূমহ বা উপাস্যসমূহ বা উপাস্যসমূহ ‘। কিন্তুু কোরানে ইহার অর্থ হইল : আল্লাহকে সর্বময় কর্তারূপে মৌখিক স্বীকার করিয়াও ইমান ও আমলের মধ্যে তদপুরি অন্যান্য বিষয়াশয়কে ইলাহরূপে গ্রহণ করা।

দেহরক্ষার প্রয়োজনে মানুষ যে সকল বিষয়বস্তুুর উপর নির্ভরশীল হইয়া থাকে সেইগুলির নিজস্ব কোনও শক্তি নাই যে, মানুষকে জাহান্নাম হইতে উদ্ধারে সাহায্য করে। উহাদের মধ্যে সৃজিত সাময়িক যে গুণাবলী রহিয়াছে সেইগুলি আল্লাহ প্রদত্ত গুণ বা শক্তি। সৃষ্ট এই শক্তিগুলি মানুষকে সৃষ্টির বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া তুলিতে পারে না। যাহারা সৃষ্টির এই গুণ সকলকে আহাদ আল্লাহর সেফাতের বিচ্ছুরণ না দেখে তাহারাই এইগুলিকে সাহায্যকারী সেনাবাহিনীরূপে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিতে চায় — অর্থাৎ সৃষ্টির মোহে আকৃষ্ট হইয়া থাকিতে চায়, যেন উহাদের সহযোগিতায় আরামে জীবন কাটাইতে পারে। ঐগুলি হইল তাহার জন্য ইলাহ। অর্থাৎ তাহার মতে ( সাময়িক হইলেও ) মৌলিক কর্তা, নেতা বা অধীকারী। কারণ এইগুলি তাহাকে অধীকার করিয়া আছে। এহেন লোক আখেরাতে বিশ্বাসী নহে। সে তাহার ইহলোকের ইলাহসমূহের বন্ধনে বিশ্বাসী। এই কারণে বিষয়-সম্পত্তির পার্থিব সকল উপকরণকে তাহার দেহরক্ষী সেনাবাহিনীর মত মনে করে। ইহার ফলে এইসব রক্ষীদল সহকারে তাহাকে জাহান্নামে ফিরাইয়া আনা হইবে। মোনের মোহের টান যাহাদের দিকে থাকিবে তাহাদের সঙ্গেই তাহার হাশর হইবে। কিন্তুু একে অন্যকে তখন চিনিতে পারিবে না।

সারা সৃষ্টি মানুষের অধীন হইয়া থাকিবার জন্য বানানো হইয়াছে। কিন্তুু আফসোস ! অধিকাংশ মানুষ আল্লাহকে একমাত্র ইলাহরূপে গ্রহণ না করিয়া এবং তাঁহার উপর নির্ভরের শোকর না করিয়া তাহারা আল্লাহ ছাড়াও তদপুরি তাহাদের কর্তারূপে অন্যান্যকে সাহায্যেকারী ইলাহরূপে গ্রহণ করিয়া থাকে। আল্লাহকে সর্বময় ক্ষমতাশালী বলিয়া মৌখিকভাবে গ্রহণ করিবার পরও তাহারা এইরূপ আচরণ করিয়া থাকে।

অতএব, যাহারা কোন ধর্ম পালন করে না, অথবা যাহারা মনের মধ্যে বস্তুুমোহ বা দূর্বল আল্লাহর আকর্ষণ প্রবল রাখিয়া প্রকাশ্যভাবে নানারূপ অনুষ্ঠান-ধর্ম পালন করে তাহাদের বিষয়ে আক্ষেপ করিয়া লাভ নাই। ইহারা মক্তির পথে অগ্রসর হইতে পারিবে না। ভিতরের মনোভাব এবং বাহিরের অভিব্যক্তি এক না করিয়া ধর্মকর্ম পালন করাও এক প্রকার সূক্ষ্ম মোনাফেকি। সংসারে প্রায় সবাই এই দলভুক্ত ধার্মিক। তাহারা এক আল্লাহর পূজা করিতেছে বলিয়া প্রকাশ করিয়া থাকে অথচ তাহাদের মন বিষয়-বাসনায় ভরপুর। অতএব, তাহাদের কথাবার্তা সকলই প্রকৃতই তৌহিদবিরোধী হইয়া থাকে। সমাজের এইরূপ অবস্থা মহামানবের নিকট অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয়। কিন্তুু আফসোস কিরিয়া কী হইবে, সংসারে প্রায় সবাই একই পথের যাত্রিক।

‘জুনদুন’ অর্থ সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী যেমন কোনও একজন রাঝাকে সাহায্যদান করিয়া রাজা হিসাবে কিছুদিন বাঁচাইয়া রাখে তেমনইভাবে দুনিয়ার প্রত্যেকটি মানুষকে বাঁচাইয়া রাখে তাহার ব্যবহার্য বস্তুুজগৎ। এই জগতের অনেক বস্তুু সেনাবাহিনীর মত মানুষকে ঘিরিয়া আছে সাহায্যকারীরূপে। কেহ খাদ্য যোগায়, কেহ স্বাস্থ্য, প্রকৃতির বিপদ-আপদ হইতে কেহ রক্ষা করে, কেহ দেয় সুখ-সাচ্ছন্দ্য ইত্যাদি। এই সকলই তাহার জীবনকে সেনাবাহিনীর মত সাহায্য দিয়া রক্ষা করিয়া আসিতেছে। কিন্তুু এইগুলি জাহান্নাম হইতে উদ্ধারের সাহায্য মোটেই তাহাকে করিতে পারিবে না। এমতাবস্থায় সে যদি আখেরাতে বিশ্বাসী না হয়; ইহজীবনকে জীবনের শেষ পরিণতি মনে করে, তাহা হইলে তাহার সমস্ত বাহিনী সমেত তাহাকে জাহান্নামেই উপস্থিত করা হইবে।

ইহাতে এই কথা বুঝায় না যে, তাহার যাহা যাহা ছিল তাহাই পুনরায় প্রাপ্ত হইবে; বরং এইগুলির মোহ-মায়া এবং কামনা-বাসনা সহকারে জাহান্নামে পাঠানো হইবে। এইসবের মধ্যে হইতে কোন্ বিষয় কতটুকু দান করিবেন তাহা মঙ্গলময় বিধাতাই ভাল জানেন।

All reactions:

9You and 8 others

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top