দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, লেখক-গবেষক এবং ইতিহাসবিদ বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসকে সত্যনিষ্ঠ ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে রচনা করার এখন জরুরি প্রয়োজন। তিনি এ জন্য নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই আহ্বান জানান।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের মৌলিক গবেষণার রচয়িতা বদরুদ্দীন উমর ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন সম্পর্কে তার অভিব্যক্তি জানাতে গিয়ে বলেন, ভাষা আন্দোলন ৭৩ বছর আগে শুরু হয়েছিল, তবে পাকিস্তানি আমলে এই আন্দোলনের ওপর উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ হয়নি। বরং প্রতি ফেব্রুয়ারি মাসে আবেগ-উচ্ছ্বাসপূর্ণ আলোচনা হতো, কিন্তু সেগুলো টুকরো আলোচনা ছাড়া কিছুই ছিল না। ভাষা আন্দোলন তখন প্রতিবাদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো, আর একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল প্রতিবাদ দিবস। তবে ১৯৭১ সালের পর, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে প্রতিবাদ দিবসটিকে শোক দিবসে পরিণত করা হয়।
তিনি আরও বলেন, শেখ মুজিব চাতুর্যের সাথে একুশে ফেব্রুয়ারিকে শোক দিবসে পরিণত করেন, যাতে ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদীদের প্রতি জনগণের আবেগ না বাড়ে। এর পর থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি আর প্রতিবাদ দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়নি, বরং একটি শোক দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে।
বদরুদ্দীন উমর বলেন, ভাষা আন্দোলন এক উজ্জীবিত বিদ্রোহ এবং প্রতিরোধের দিন ছিল, কিন্তু পরে তা শোকের মধ্যে পরিণত হয়। তিনি অভিযোগ করেন যে, এই দিবস এখন আর আগের মতো আবেগে পূর্ণ নয় এবং বর্তমানে এটি একটি রিচুয়াল বা রীতির মতো পালন করা হয়।
ভাষার বর্তমান অবস্থাও নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং বলেন, বাংলা ভাষা এখনও সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এমনকি অনেক ভালো ছাত্রও বাংলা ভাষা জানে না এবং কিছু ছাত্র ইংরেজি জানার দাপটে বাংলা ভাষাকে তুচ্ছ করে।
শেখ মুজিবের ভূমিকা প্রসঙ্গে, বদরুদ্দীন উমর বলেন, ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের কোনো ভূমিকা ছিল না, বরং তিনি ১৯৫২ সালে জেলে ছিলেন। যদিও শেখ হাসিনা দাবি করেন যে তার বাবা ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, বদরুদ্দীন উমর তা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য যে ভাষা সমস্যাটি ওঠে, তাতে পাকিস্তানী শাসকরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেন, যা মূলত ভারতের মুসলিমদের ভাষা ছিল।
এছাড়া, বদরুদ্দীন উমর জানান যে, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন তখনকার কোনো রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল না এবং আওয়ামী লীগের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল না। তবে, যুবলীগের কিছু সদস্য ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল।
তিনি মন্তব্য করেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শাসনকালে জনগণের জন্য কিছুই পাওয়া যায়নি এবং ১৫ আগস্ট তাকে হত্যা করার পর জনগণের প্রতিক্রিয়া ছিল উল্লেখযোগ্য, কারণ তখন কেউ শোক প্রকাশ করেনি বরং উল্লাস প্রকাশ করেছে।
এভাবে, বদরুদ্দীন উমর দেশ ও জাতির ইতিহাসের বিকৃতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন এবং সঠিক ইতিহাস রচনার জন্য নতুন প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।