আত্মকথা
কেকা অধিকারী
যতদূর মনে পড়ে কোলকাতার নিউমার্কেটের আশেপাশের রাস্তা ছিল ওটা। হাঁটছিলাম আমরা। ২০১৭ সালের নভেম্বরের ৭ বা ৮ তারিখের সন্ধ্যা বেলায়। আমি আর বান্ধবী মিলি। সিমেন্ট বাঁধানো ফুটপাতের মধ্যে মধ্যে গাছগুলো ছিল। ছোট ছোট গাছ। আমাদের মাথা ছাড়িয়ে আরেকটু বেশি লম্বা। লাইটের আলো আঁধারিতে লক্ষ্য করলাম গাছগুলো ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। তবে তাতে রঙের বাহার নেই। সবুজ পাতার চেয়ে হালকা, সবুজাভ হলদেটে তার রঙ। অনেকটা হাস্নাহেনার মতো দেখতে। ফুলের এমন বিশাল প্রাচুর্য যে দৃষ্টি না আটকে পারে না। আমি মিলিকে দেখালাম। মিলি ফুলগুলো দেখে সাথে সাথে বললো “ছাতিম”। আমি চমকে গেলাম। দুটো কারণে- প্রথমতঃ মিলি চেনে! দ্বিতীয়তঃ নামে এতো পরিচিত অথচ আমি গাছটাই চিনি না!
ফুটপাতে ম্যালা মানুষজনের চলাফেরা। সেখানে দাঁড়িয়ে ফুলগুলো ভালো করে দেখব তার উপায় নেই। স্বল্পভাষী মিলি বিরামহীন বলে চলেছে বরিশাল শহরের ব্যাপ্টিষ্ট মিশন গার্লস স্কুলের হোস্টেলে থাকাকালীন তার কৈশোরের দিনগুলোর কথা যেখানে তার অনেক অনেক স্মৃতি আছে এ ফুলের সাথে। সে ছাতিম ফুলের তীব্র ঘ্রাণের কথা বলছে। আমি বলে উঠলাম,
- কোথায় গন্ধ? আমি তো কিছু টের পাচ্ছি না!
- কী বল তুমি, সত্যিই পাচ্ছো না?
সত্যিই আমি আলাদা করে কোন ফুলের গন্ধ পাচ্ছিলাম না। গভীর শ্বাস টেনে বুকের ভেতরটা ভরে ফেললাম অক্সিজেনে। মনে হলো নিউমার্কেটের বিভিন্ন পন্যসামগ্রীর জগাখিচুরী গন্ধ। মিলি আমার জন্য গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে নিতে চাইলে আমি না করলাম। গাছের জন্য মায়া হল। তখন ও একটা ফুলসমেত ডাল নিচে টেনে নামাল। আমি পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে কাছ থেকে ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তারপরেও ফুলের বিশেষ গন্ধটি অনুভব করতে পারলাম না। ফুলের গন্ধ না কি এতো তীব্র, অথচ আমি একটুও পাচ্ছি না! কী সমস্যা আমার? মাথায় ঢুকে থাকলো বিষয়টি।
এরপর কত হেমন্ত এলোগেলো। কত শত ছাতিম গাছ ফুলে ফুলে ভরে উঠল। আমার নজরও কাড়ল তাদের কেউ কেউ। আমি চলতি পথে দূর থেকে তাদের দেখেছি কেবল। কাছে যাওয়া হয়নি বলে ঘ্রাণও নেয়া হলো না। এবার ফেসবুকে নানাজনের পোস্ট দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার ছাতিম ফুলের গন্ধ-রহস্য উদঘাটন করবোই করবো।
জয়পুরহাট পৌরসভায় আমার পাশের রুমের প্রতিবেশী প্রকৃতিপ্রমী তরুণ নোমানকে জিজ্ঞেস করলাম তাদের শহরের কোথায় গেলে আমি ছাতিমের দেখা পাব। ও আমাকে একদম ঠিকানাসহ দিক নিদর্শনা দিয়ে দিল, “খঞ্জনপুরের চকসাম ব্রিজের কাছে।”
বাসায় ফিরে তিনতলায় নয়, গেলাম দোতলায় আমার বান্ধবী বাড়িওয়ালী আপার কাছে। প্রস্তাব পাড়লাম ছাতিম উৎসবে যোগ দেয়ার। তিনি তাাৎক্ষণিক রাজী হলে কন্যা ও নাতনি দুজনও আগ্রহী হলো। জয়পুরহাটে আমার অন্ধের যষ্টি মাসুমকে ফোন করলাম। ও দেরী না করে ইজিবাইক নিয়ে হাজির হলো। আমরা সদলবলে আকাশে পূর্ণ চন্দ্র দেখতে দেখতে রওনা হলাম ছাতিম তরুর সন্ধানে।
অবশেষে আমাদের ইজিবাইক বিশাল এক ছাতিম গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। গাছের নিচটা ফুলের কার্পেট হয়ে আছে যেন। তীব্র গন্ধ পেলাম এবার। ভীষণ তীব্র একটা ঘ্রাণ। না, এ কোন ফুলের মৃদু সুবাসের মতো নয়। কোন সুগন্ধির সাথেও তার তুলনা চলে না। নেশা জাগানিয়া এক আবেশ। আকর্ষকও বটে। অবশ্য অনেকের কাছে এটা পোকার গন্ধ বলে মনে হয় শুনেছি। আমি বেশ উপভোগ করছিলাম চাঁদের আলোয় একটা গাছ ঘিরে আমাদের সবার উত্তেজনা।
এরমধ্যে বড় নাতনি তার মোবাইল ফোনের ফ্লাশ জ্বালালো। সেই আলোতে আমরা একে একে নানান রঙে স্মৃতি ধরে রাখলাম। কোলকাতায় দেখা গাছের চেয়ে এ গাছের আকার অনেক অনেক গুন বড়। তবে এবারও ডাল টেনে নিচে নামিয়ে ফুল দেখা, ছবি তোলা চললো। সবাই ছবি তুললাম। কিন্তু আমাদের কন্যাটা কোথায়? ওকে ডাকলে ও বলল,
- আন্টি, আপনারা ছবি তোলেন। আমার ফুলের গন্ধে কেমন যেন লাগছে। মাথাটাঢেকে ঘুরাচ্ছে। আমি ঐ ইজিবাইকে গিয়ে বসি।
আহা বেচারা, শরীর খারাপ লাগায় আর গাছের কাছে আসতে পারল না।
আমরা একটু দূরের ছোট্ট চায়ের দোকানে গিয়ে গাছটির বৃত্তান্ত জানতে চাইলাম। কত বছর বয়স তার? দোকানীর ভাষায় “৫০/৫৫ তো হবেই”।
ফিরে আসার সময় ছাতিম ফুলকে ছেড়ে আসতে মন চাইল না। তাকে আরও ভালো ভাবে অনুভবে রাখার ইচ্ছে হলো। গাছ ও কন্যার কাছে ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক ফুলসমেত একটি ডাল ভেঙে সাথে নিলাম।।
হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে যখন আমরা ফিরছি তখনও ছাতিম ফুলের ডালটা আমার হাতে। এখন সেটা জলভরা পাত্রে আমার বেডরুমে ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। বান্ধবী সুমীকে ম্যাসেঞ্জারে ছাতিম ফুলের গল্প করলে ও বলল,
- ফুল শুকালে বই চাপা দিয়ে আমার জন্য রেখে দিও।
তা রাখব। সাথে বুকের ভেতরে রেখে দেব ছাতিম ফুলের গন্ধ। সঙ্গে থাকবে সাতটি করে পাতায় পাতায় সাজানো সপ্তপর্ণী উৎসবের স্মৃতি।
” জীবন মানে আর কিছু নয়, জীবন তো উৎসব। “