বৃহস্পতিবার, সকাল ১০:৫৯, ৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বৃহস্পতিবার, সকাল ১০:৫৯, ৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আজ কারো জন্মদিন না, আজ বাংলাদেশের জন্মের প্রথম শুভক্ষণ

আসাদ উল্লাহ তুষার

“আজ কারো জন্মদিন না

আজ বাংলাদেশের জন্মের প্রথম শুভক্ষণ “

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবদ্দশায় তার নিজের জন্মের গান লিখে গেছেন।

হে নূতন,

দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ ।।

তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন

সূর্যের মতন ।

রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন ।

ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,

ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময় ।

উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্তমাঝে

চিরনূতনেরে দিল ডাক

পঁচিশে বৈশাখ ।।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নোবেল জয়ী বিশ্বকবি। তাই তিনি তার জন্মের শুভক্ষণের গান লিখে গেছেন। আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন “পয়েট অফ পলিটিক্স ” রাজনীতির কবি। তাকে নিয়ে দেশ বিদেশের নামি লেখক কবিরা গান লিখেছেন। নিশ্চয়ই তার জন্মদিন নিয়েও অনেক কবিতাও লিখেছেন। অবশ্য বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় জন্মদিন পালন করতেন না। বরং তিনি বলতেন, আমার আবার জন্মদিনই কি আর মৃত্যু দিনই কি? কিন্তু বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ যতদিন থাকবে সতেরই মার্চ পালিত হবে, উদযাপিত হবে। তাই সতেরই মার্চকে বলি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।

১৭ ই মার্চ ১৯২০ সালে গোপালগঞ্জের টুংগিপাড়ায় মধুমতির পারে পিতা মাতার কোল আলো করে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন আদরের খোকা শেখ মুজিবুর রহমান। সময়কালটা ছিল ব্রিটিশ শাসনামল। সেদিন কি তার পিতা মাতা জানতেন তাদের এই সন্তানের হাত ধরেই একদিন এই ভূখণ্ড স্বাধীন হবে। কিন্তু হয়েছিল তাই। তার জন্মের ৫০ বছরের মাথায় স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হয়েছিল। যার নাম বাংলাদেশ। একদিন তিনিই হয়ে উঠলেন দেশটির জাতির পিতা।

একদম ডানপিটে যাকে বলে। পড়ালেখায় যতটা না মন তার চেয়ে বেশি খেলাধুলা ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে চলাফেরা করতে ভালো লাগে। ফুটবল ভালো খেলতেন, পিতার বিপরীতে নিজের টিম নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেন। নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে অন্যকে সহযোগিতা করতেন। কেউ বিপদে পড়লে উদ্ধারের জন্য আগে নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন সামনে থেকে নির্ভয়ে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিপদেও পড়েছেন, চক্ষুশুল হয়েছেন কারো কারো। কিন্তু দৃঢ়ভাবে এগিয়ে গিয়েছেন। সবকিছুতেই নেতৃত্ব দেয়ার এক ধরনের বাসনা ছিল। নেতৃত্ব গুনটা একেবারে ছোটকাল থেকেই ছিল। সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল ছোট বয়স থেকেই। স্কুলছাত্রাবস্থায় দাবি দাওয়া নিয়ে কথা বলতেন বড়দের সাথে,মন্ত্রী নেতাদের সাথে। স্কুলের ছাত্রাবস্থায় নেতৃত্ব দিতে গিয়ে জেল খেটেছেন। কোনদিন অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি আপোষ করেননি। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দয়া ছিল অপরিসীম।

মানুষ মরণশীল। জন্মিলে মরিতে হইবে সৃষ্টিকর্তার এক অমোঘ সত্যি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড বা তাঁর মৃত্যু বাঙালিকে এতিম করে দিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু সশরীরে বেঁচে নাই এটা যেমন সত্যি তেমনি বেঁচে থাকলে আজ শত বছর পেড়িয়ে যেতেন। মাত্র পঞ্চান্ন বছর বেঁচেছিলেন ইতিহাসের এই রাখাল রাজা। কি এমন বয়স হয়েছিল? এখনকার গড় আয়ুর তুলনায় সেটা ছিল অল্প। এই অল্প কিছুদিন বেঁচে থেকে কি অবিশ্বাস্য সব অর্জনই না তিনি করেছিলেন। পাশাপাশি অনেক কষ্ট তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল। জেলজুলুম নির্যাতন ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী। সব কিছুই তিনি করেছিলেন বাংলার জন্য বাঙালির জন্য। বঙ্গবন্ধু যদি আর বিশটি বছর কাজ করার সুযোগ পেতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান ও একক নেতা হিসেবে,জাতির পিতা হিসেবে দেশের জন্য দুই দশক কাজ করার সুযোগ পেলে বাংলাদেশ অনেক আগেই বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতো। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট ঘাতকেরা তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বঙ্গবন্ধু বেঁচে নাই এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সদ্য স্বাধীন দেশে যখন বঙ্গবন্ধু দেশ গড়ার কাজে নিজেকে এবং দেশবাসীকে আত্মনিয়োগ করার জন্য কোমর বেঁধে নেমেছিলেন, যখন একটি স্থিতিশীল অবস্থায় দেশ পৌঁছেছিল ঠিক তখনই চক্রান্তকারীরা দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়। ভাবা যায়? স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের একটু বেশী সময়ে স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই!

যিনি তাঁর স্বল্প সময়ের জীবদ্দশায় জীবন যৌবনের সাড়ে চৌদ্দ বছর জেলে জেলে থেকে নিপীড়ন নির্যাতন সহ্য করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বাঙালিকে এক সুতায় গেঁথেছিলেন। হাজার বছরের পরাধীনতা ছিন্ন করে বীর বাঙালিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুলক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। তাঁকেই কিনা ঘাতকেরা সাড়ে তিন বছরের মাথায় নির্মমভাবে হত্যা করে! যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য একটি স্বাধীন দেশের জন্য কি না করেছিলেন বঙ্গবন্ধু ? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধংশলীলার উপর দাঁড়িয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন। জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসি সহ প্রায় সব আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশ সদস্য পদ অর্জন করেছিলেন। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দেশের অবকাঠামো অল্প সময়ের মধ্যেই প্রায় স্বাভাবিক করে ফেলেছিলেন। দেশী বিদেশী চক্রান্ত তখনও চলছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্ব ও সম্মোহনী নেতৃত্বের কারণে বিশ্ববরেণ্য নেতায় পরিণত হচ্ছিলেন। বিশ্বব্যাপী শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর তখনই শুরু হয়েছিল দেশী বিদেশী চক্রান্ত ষড়যন্ত্র।

বঙ্গবন্ধু তাঁর সিংহ হৃদয় দিয়ে মানুষের মন জয় করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনাবসনের পর পাকিস্তান সৃষ্টির পরে এই ভূখণ্ডে অনেক বড় বড় নেতা ছিলেন। অনেকেই বঙ্গবন্ধুরও নেতা ছিলেন। কিন্তু কেউই এই বাংলার মানুষের আবেগ অনুভূতি ধরতে পারেননি।বুঝতে পারেননি বা বোঝার চেষ্টা করেননি বাঙালির আশা আকাঙ্ক্ষা বা চিন্তা চেতনা। বঙ্গবন্ধু যা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন,ধারণ করেছিলেন । মানুষের মনের ভাষা বুঝতে পারতেন মুজিব। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে তাঁদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তুলতেন। ঢাকায় বসে তৎকালীন নেতারা যখন আরাম আয়েশে থাকতেন বঙ্গবন্ধু তখন অনেক কষ্ট করে মফস্বলে গিয়ে দিনের পর দিন জনসভা করে মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে উজ্জীবিত করতেন। তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত নেতা কর্মীদের চিনতেন তাদের নাম জানতেন। বলা চলে তাঁর একক প্রচেষ্টায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। আর এই প্রতিষ্ঠানকে সামনে রেখেই বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে মুজিব এবং এই বাংলার অধিকার হারা মানুষ। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের ও তাঁর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। কৃতজ্ঞ বাঙালি তাঁকে জাতির পিতার আসনে বসায়।

পাকিস্তান আমল থেকে এই ভূখণ্ডের মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর যে ভালোবাসা ছিল তা দিনদিন আরো বৃদ্ধি পায় এবং একসময় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একসুতোয় বাঁধা পরে। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল মানুষকে ভালোবাসা। তিনি তাঁর দেশের মানুষকে যেমন ভালোবাসতেন তাঁর দেশের মানুষও তাঁকে তেমনি ভালবাসতেন। মানুষের ভালোবাসাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের লড়াই সংগ্রামের মূল প্রেরণা। মানুষের ভালোবাসার কারণেই এবং তাদের জীবন বাজি রেখে লড়াই সংগ্রামের কারণেই ফাঁসির কাষ্ঠ থেকে ফিরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু । আর ফিরে এসেছিলেন বলেই তাঁর নেতৃত্বে আমরা আমাদের শত শত বছরের কাঙ্ক্ষিত সেই স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছিলাম ।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নিজ আসন গোপালগঞ্জ থেকে প্রার্থী হলে সেখানকার মানুষেরা যে অভূতপূর্ব ভালবাসা দেখায় তার বর্ণনা তিনি তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বর্ণনা করেছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়ে তাঁর এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে…” আমার মনে আছে খুবই গরীব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, “বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে।” আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসে দিয়ে একবাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, “খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।” আমার চোখে পানি এল। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে, সেই পয়সার সাথে আরো কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, “তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না।” টাকা সে নিল না, আমার মাথায় মুখে হাত দিয়ে বলল, “গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা।” নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেদিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ‘মানুষেরে ধোকা আমি দিতে পারবো না।’ এরকম আরও অনেক ঘটনা ঘটেছিল ।” আমৃত্যু বঙ্গবন্ধু তাঁর সেই কথা রেখেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং তাঁর শাহাদতের পরেও প্রায় তাঁর বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর অমানবিক অপপ্রচার হয়েছে যা এখন আবার নতুন করে শুরু হয়েছে । তাতে বাংলার মানুষের কাছ থেকে, পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকে এতটুকুও তাঁকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে নাই কুচক্রীরা, পারবেও না। বরং বঙ্গবন্ধু দিন দিন মানুষের কাছে আরো উজ্জ্বল, আরো দীপ্তিময় হয়ে উঠেছেন,উঠছেন । দিন আরো যত যাবে কুচক্রীরা ইতিহাসে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। আর বঙ্গবন্ধু তাঁর কর্মের, তাঁর অপরিসীম ত্যাগ ও মানুষকে ভালোবাসার কারণে বাংলার ঘরে ঘরে, বাঙালির মননে,হৃদয়ে দিন দিন প্রজ্জ্বলিত শিখার মত উজ্জ্বল হয়ে জ্বলবে। জন্মদিনে অপরিসীম শ্রদ্ধা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আসাদ উল্লাহ তুষার

সম্পাদক, রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top