কেকা অধিকারী
প্রতি : বাবা ( শ্বশুরমশায়)/
প্রিয় বাবা,
, আজ আপনার মৃত্যুবার্ষিকী। আজ ১৩ বছর হলো আমাদের অদেখা-দেখির। একটা স্মৃতি মনে পড়ছে খুব। প্রায়ই এটা মনে পড়ে। আমার সামনে ঘটা একটা ঘটনা এটি। ঘটনা ও কথপোকথন। কথপোকথনটা হয়েছিল দু’জন ব্যক্তির মধ্যে – একজন আপনি, অন্যজনের পরিচয়টা বলতে চাইছি না। আপনি তো জানেনই। সময়কাল আমার বিয়ের ২ বা ৩ মাসের মধ্যে কোন একদিনের বিকেল বেলা। অন্য ব্যক্তিটি এসে আপনার কয়েকটি শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি জড়ো করে ব্যাগে ভরছেন। ছোট্ট ড্রইং রুমের সোফায় বসে কাজটি তিনি করছিলেন। কথপোকথনটি সে সময়ের। আমি একটু দূরে ডাইনিং টেবিলে কিছু একটা করছি। শ্বশুরমশায়: আমার শার্ট প্যান্ট ব্যাগে ভরছিস কেন? কী করবি? ব্যক্তিটি: আপনার কাপড়চোপড়ের কী অবস্থা? কেমন সব কোঁচকানো কাপড় পরে বাইরে যান। নিয়ে যাচ্ছি। আয়রন করে দিয়ে যাবো। শ্বশুর মশায়: খবরদার! আমার কাপড় যেখানে ছিল সেখানে রেখে আয়। কোথায়ও নিবি না। আমি কী খাচ্ছি, কী পরছি.. ……. যারা আপনাকে চেনেন তারা জানেন আপনি কতোটা মৃদুভাষী ও নিরীহ মানুষ ছিলেন। আপনার অমন রেগে যাওয়া মূর্তি আমি সেদিনই প্রথম দেখেছিলাম। পরেও খুব বেশি দেখিনি। সত্যিটা হলো আমরা একসাথে কোথায়ও বেড়াতে গেলে আমি সব সময় আপনি কী জামা পরেছেন, সব কিছু ঠিক আছে কি না তা লক্ষ্য করতাম। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে পারফিউম এনে আপনার গায়ে দিয়েও দিতাম। তবে সত্যি সত্যি আমি তখনও আপনি প্রতিদিন যখন বাইরে যেতেন, মেয়েদের বাসায় যেতেন তখন কেমন পোশাকে বের হতেন তা খেয়াল করতাম না। অবশ্য বহু বছর আগে শাশুড়ি মা গত হওয়ায় আপনি নিজে একজন স্বাবলম্বী মানুষ ছিলেন। স্বভাবেও ছিলেন গোছানো পরিপাটি। আপনি জানতেন আমার প্রকৃতি। আমি প্রকৃত অর্থেই অকর্মণ্য, অলস, এলোমেলো স্বভাবের। আপনার অবশ্যই চোখ এড়ায়নি যে, আমার বাবা এসে আমার নোংরা জামা কাপড়, শাড়ি নিয়ে যেতেন আর দু’তিন দিন পর পরিষ্কার আয়রন করা ব্যাগভর্তি কাপড় ফেরত দিয়ে যেতেন। (আমার জানা ছিল বরাবরের মতো তার মধ্যে সালোয়ার কামিজ কয়টি বাবা নিজের হাতে আয়রন করেছেন। শাড়িগুলো লন্ড্রি থেকে) তখন দুই বেয়াইয়ের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ গল্প হতো। অন্য দিকে প্রদীপ ওর কাপড় লন্ড্রি থেকে আয়রন করিয়ে আনতো। আপনাকে আমার কখনও “ভরা গলায় বাবা” ডাকা হয়ে ওঠেনি। প্রায়ই মনে হতো – এমন অবস্থায় মুসলমানদের খুব সুবিধা। নিজের বাবা-মাকে “বাবা-মা” ডাকলে অনায়াসে তারা শ্বশুর শাশুড়িকে “আব্বা-আম্মা” ডাকতে পারে। আমি কেন যেন আপনাকে বাবা সম্বোধনে সহজ হতে পারিনি কোনদিন। বিশেষ করে আমার বাবার সামনে। বেশির ভাগ সময় ভাববাচ্যে কথা বলেছি আমি আপনার সাথে। সেদিন আপনি জোরে ঐ ব্যক্তিকে বকা দিলে আপনার কথার মধ্য আমি নিজের জন্য অনেক বেশি ভরসা পেয়েছিলাম। আমি জেনেছি আমার অযোগ্যতাকে পূঁজি করে বাজারজাত করার বিষয়ে আপনার কোন প্রশ্রয় ছিল না। সমর্থনও ছিল না। পিছনে ফিরে যদি দেখি তবে অনুভব করি নতুন জীবনে একমাত্র আপনিই আমাকে আমার সব দোষগুন ও অযোগ্যতাসহ গ্রহণ করেছিলেন। আমার সংসারী না হওয়াটাকে ভেতর থেকে মেনে নিয়েছিলেন। এভাবে দু’তরফেই আমাদের সম্পর্ক এগিয়েছে ভালো লাগা, মন্দলাগা, দুটোকেই সাথে নিয়ে। ঘর সংসারের অনেক কিছু আপনার কাছে শিখেছি। প্রাত্যহিক সাধারণ রান্না বান্নার অনেকটা আপনি হাতে ধরে শেখাতে চেষ্টা করছেন। শুধু কি তাই? সংসারে থেকেও একাকী জীবনের পাঠও আমার নেয়া হয়েছে আপনার কাছ থেকে। বিয়ের পর আমি আপনাকে পেয়েছিলাম আমার ও নতুন পরিবারের মধ্যে সংযোগ সেতু কিম্বা ভারসাম্য রক্ষাকারী হিসেবে। আপনাদের পরিবারের করো কাছ থেকে কষ্ট পেলে, অবিচার পেলে, কোন অভিযোগ থাকলে আমি আপনার কাছে এসে বলতে বলতে কেঁদে ফেলতাম, চিৎকার চেঁচামেচি করতে পারতাম। আপনি কখনও সেগুলো পাঁচকান করতেন না। আমাকে বোঝাতেন। আমাকে বুঝতেনও আপনি । সংসার জীবনে এমন কিছুটা পেয়েছিলাম আরেকজনের কাছ থেকে। তিনি আমার ছোট পিসীমা শাশুড়ি। আপনারা দু’জনই আজ অধরায় ঠাঁই নিয়েছেন অনেক বছর। উপরের ঘটনার মতো আপনাকে ঘিরে এমন অনেক ঘটনা, স্মৃতি আমার প্রায়ই মনে পরে। ( আপনারও নিশ্চয় পড়ে আপনাকে দেয়া আমার কষ্টগুলো)। লিখতেও ইচ্ছে করে। কিন্তু লেখা হয় না। বোঝেনই তো আমাদের সমাজে বাবাকে নিয়ে লেখা সহজ, শ্বশুরকে নিয়ে নয়। উৎসাহ আর পাঠক পেলে না হয় লিখব সে সব মাঝে মধ্যে। বাবা (এখন আপনাকে মন থেকেই সম্বোধনটি করলাম), আপনকেই আমি আপন হিসেবে, শুভাকাঙ্ক্ষী পেয়েছিলাম। হঠাৎ হঠাৎ আমরা দু’জন যেমন দীর্ঘ আড্ডা দিতাম, ওপারে দেখা হলে তেমন না হয় আরেক বার দিব। গীর্জা ঘরে আপনার উৎসর্গ সভার সময় যেমন আমাকে আপনার পাশে ডেকে নিয়ে বসিয়েছিলেন তেমন না হয় আবার আমাকে ডেকে নিয়েন। ভালো থাকবেন বাবা অনন্ত আকাশে। ভালোবাসি। –
আপনার পাগলী (আপনি আমাকে মাঝে মাঝে “দূর পাগলী” বলতেন।
ছবি: শ্বশুরমশায়ের কোলে আমার ভুমলু।