জাকেরিন
প্রযুক্তি: আধুনিক সমাজের অগ্রগতির চাবিকাঠি প্রযুক্তি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতি এবং উন্নতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে পৃথিবীটির চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। একে একে বিভিন্ন সেক্টরে প্রযুক্তির প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যবসা, পরিবহন, ইত্যাদি। পৃথিবী এখন প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছে, যেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রযুক্তি প্রয়োজনীয় এবং অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির সংজ্ঞা প্রযুক্তি বলতে সাধারণভাবে বোঝানো হয় মানবসমাজের প্রয়োজন পূরণের জন্য বিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিক। এটি যেকোনো কাজ বা কাজের উপকরণ তৈরি করার কৌশল বা প্রক্রিয়া হতে পারে, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ এবং কার্যকরী করে তোলে। প্রযুক্তি এমন এক প্রক্রিয়া যা মানুষের চাহিদা মেটাতে নতুন নতুন উদ্ভাবন করতে সাহায্য করে এবং সেই উদ্ভাবনগুলো সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রযুক্তির ইতিহাস প্রযুক্তির ইতিহাস অনেক পুরনো, প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষ নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। প্রথম দিকে, মানুষের মূল প্রযুক্তি ছিল অস্ত্র, কৃষি উপকরণ এবং অন্যান্য দৈনন্দিন ব্যবহারের উপকরণ। তবে সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে থাকে এবং ১৮০০ শতাব্দী থেকে প্রযুক্তির অগ্রগতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। বৈদ্যুতিক শক্তি, তাপীয় শক্তি, মেকানিক্যাল শক্তি ইত্যাদি আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষ দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির সুফল পেতে শুরু করে। বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীতে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব ঘটেছে। কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোনের মতো প্রযুক্তি মানুষের জীবনযাত্রা সহজ এবং দ্রুততর করেছে। তথ্য প্রবাহের ক্ষেত্রেও প্রযুক্তি এক নতুন যুগের সৃষ্টি করেছে, যার ফলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় তথ্য পাঠানো বা প্রাপ্তি অনেক সহজ হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির সুবিধা প্রযুক্তির সুবিধাগুলো অনেক। প্রথমত, এটি মানুষের জীবনযাত্রাকে অনেক সহজ করে তোলে। আজকের দিনে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, এবং অন্যান্য ডিভাইসের মাধ্যমে মানুষের কাজের গতি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। চিকিৎসা খাতে প্রযুক্তির উন্নতি রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসায় নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষ ঘরে বসে যেকোনো ধরনের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে, বিভিন্ন পরিষেবা গ্রহণ করতে পারে, এমনকি বিদেশের সাথে যোগাযোগও করতে পারে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ক্ষেত্রেও প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ, ডিজিটাল লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ভিডিও কনফারেন্সিং ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষা এখন সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে পৌঁছেছে। ছাত্ররা ঘরে বসেই বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে শিক্ষাপ্রদ কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে। তৃতীয়ত, প্রযুক্তি ব্যবসা ও শিল্প খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি, রোবটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ইত্যাদির সাহায্যে উৎপাদন প্রক্রিয়া দ্রুত এবং সঠিকভাবে সম্পাদিত হচ্ছে। এটি ব্যবসার বৃদ্ধি এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করছে। প্রযুক্তির নেতিবাচক দিক তবে প্রযুক্তি সবসময় সুফল নিয়ে আসে না। এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল প্রযুক্তির কারণে মানুষের মধ্যে একাকীত্ব বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে মানুষ একে অপরের সাথে যোগাযোগ করলেও, তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের মান কমে যাচ্ছে এবং একাকীত্বের অনুভূতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরেকটি সমস্যা হল প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার স্বাস্থ্যগত ক্ষতি করতে পারে। দীর্ঘ সময় কম্পিউটার, স্মার্টফোন বা টিভির সামনে বসে থাকার কারণে চোখের সমস্যা, শারীরিক দুর্বলতা, মানসিক চাপ, এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশুদের ওপর প্রযুক্তির প্রভাব বেশি পড়ছে, যার কারণে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে। প্রযুক্তির কারণে কর্মসংস্থানে অটোমেশন এবং রোবটিক্সের ব্যবহারে কিছু মানুষ তাদের চাকরি হারাতে পারেন। যেসব কাজ মানুষ হাতে করে, তা রোবট বা যন্ত্রের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা শুরু হয়েছে, যার ফলে অনেক মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রযুক্তি এবং ভবিষ্যৎ ভবিষ্যতে প্রযুক্তির ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), রোবটিক্স, ন্যানোটেকনোলজি, ব্লকচেইন, ৫জি টেলিকমিউনিকেশন, ইত্যাদি প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আরও নতুন নতুন পরিবর্তন আনবে। তবে, এ সকল প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের উন্নয়ন, শিক্ষার প্রসার এবং মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার প্রয়োজন। তাছাড়া, প্রযুক্তি ব্যবহারে নৈতিকতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। মানুষকে প্রযুক্তির সুফল গ্রহণের পাশাপাশি এর ক্ষতিকর দিক থেকে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে প্রযুক্তির মাধ্যমে যেকোনো ধরনের মিথ্যা বা বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা, অথবা সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করা যেমন বিষয়গুলোতে সতর্ক হওয়া জরুরি। প্রযুক্তি মানুষের জন্য এক অপার সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। এটি একদিকে যেমন আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, তেমনি অন্যদিকে কিছু সামাজিক, শারীরিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। অতএব, প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের সকলকে সতর্ক এবং সচেতন থাকতে হবে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং নিয়মিত সংস্করণের মাধ্যমে আমরা আরও উন্নত, সমৃদ্ধ এবং সুখী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারব।