অধ্যাপক ডা. মুনিরা ফেরদৌসী এমবিবিএস এমপিএইচ ( ঢাকা) এমএস ( অবস্ এন্ড গাইনী) গাইনোকোলজিস্ট
( করোনাকালীন সময়ে অধ্যাপক ডা. মুনিরা ফেরদৌসীর লেখা)
আমি জানি না এই কথাটা বলার আর সুযোগ পাবো কিনা, জানি না করোনার ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পাবো কিনা ৷ যে কোন মুহূর্তেই আক্রান্ত হয়ে যেতে পারি৷ তবে আমি কথা দিচ্ছি আক্রান্ত হবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি আপনাদের সেবায় নিয়োজিত থাকবো৷ আজ আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি তাঁদের কথা যাঁদের কারনে আমার এতোদুর পথ অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে৷ এইচ এস সি পাশ করার পর পরই বিয়ের কথাবার্তা শুরু হয়ে গেলো৷ আমার জেদাজেদিতে আর আব্বা, আম্মার একান্ত চেষ্টায় বিয়েটা ঠেকানো গেলো এই বলে যে কোথাও আগে ভর্তি হয়ে নেই৷ বাবার স্বপ্ন ছিলো মেয়ে ডাক্তার হবে৷ চান্স পেলাম মেডিক্যালে৷ তারপরপরই বিয়েটাও হয়ে গেলো৷ শুরু হলো মেডিক্যালের সংগ্রামী জীবন আর সংসার জীবন৷ এক বছরের মাথায় আমার কোল আলো করে আসলো আমার প্রথম সন্তান৷ পড়াশুনা, আইটেম, কার্ড ফাইনাল, সংসার সবকিছু নিয়ে আমি দিশাহারা৷ কিছুই করে উঠা সম্ভব ছিলোনা যদি আমার আম্মা আব্বা, আমার husband, আমার ভাইবোনেরা আমার পাশে না থাকতেন৷ কি কষ্টটাই না করতে হয়েছে৷ আমার আম্মা চাকুরী করতেন মিশন স্কুলে৷ আমি ভোরে চলে যেতাম ক্লাশে আর আম্মা বাচ্চাটাকে নিয়ে যেতেন তাঁর স্কুলে৷ তখন তো গাড়ীও ছিলো না, বাসা থেকে স্কুলের দুরত্ব ছিলো প্রায় ৫ কিলোমিটার৷ আম্মা যেতেন রিক্সা করে আর আমি ক্লাশ শেষ করে মেডিক্যালের বাসে করে যেতাম আম্মার স্কুলে ওখান থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে আসতাম বাসায়৷ বাচ্চাটার কি কম কষ্ট হতো? পাশ করার পর আবার আব্বার ইচ্ছায় বিসিএস পরীক্ষা দেওয়া ৷ একটুও ইচ্ছা ছিলো না পরীক্ষা দেবার কেননা আমি আবার ২য় বারের মতো মা হতে যাচ্ছিলাম৷ আর প্রতিটি pregnancy te আমার ভয়াবহ বমি হতো , আমি কিচ্ছু খেতে পারতাম না…..এখন তো অনেক medicine পাওয়া যায় তখন এরকম কোন medicine ও পেতাম না৷ যাই হোক পরীক্ষা দিলাম, উত্তীর্ণও হলাম৷ এরপর করেছি NIPSOM থেকে MPH (EPIDEMIOLOGY) ৷ রাজশাহীতে বাচ্চা দুটোকে আম্মা, আব্বার কাছে রেখে চলে আসলাম ঢাকায়৷ আমি ঢাকায়, বাচ্চারা রাজশাহী, আর বরের পোষ্টিং বগুড়া৷ শুরু হলো আবার একটা যুদ্ধ৷ অবশেষে একবছরের যুদ্ধ শেষে পরিবারের কাছে প্রত্যাবর্তন ৷ ভেবেছিলাম আর কোন পড়াশুনা করবো না৷ এবার শুরু হোল বরেব আত্যাচার৷ বউকে উনি উচ্চশিক্ষিত বানাবেনই৷ EPIDEMIOLOGIST বউ না এবার GYNAECOLOGIST বউ দরকার৷ বরের ইচ্ছা আর আমার ম্যাডামের ইচ্ছায় আবার পড়াশুনা ৷ আমার ম্যাডাম যাঁর আদর , ভালবাসা , শাসন না পেলে আজ আমার এই অবস্হানে আসা কোনদিন ই সম্ভব হতো না ৷ উনি আমার শ্রদ্ধেয় ম্যাডাম অধ্যাপক ডাঃ ফাতেমা বেগম৷ আল্লাহ্ উনাকে ভালো রাখুন৷ এবার ভর্তি হলাম MS (OBGYN) , MITFORD এ৷ শুরু হলো আবার লম্বা পথচলা৷ এবার বাচ্চারা আব্বা আম্মার সাথে রাজশাহীতে , বর সিরাজগন্জে, আমি আবার ঢাকার হোষ্টেলে৷ আমি দুঃখিত আমার সোনা বাচ্চারা , আমি তোমাদেরকে ঠিকমতো সময় দিতে পারি নাই৷ আমাকে ছাড়া তোমাদেরকে কতো সময় কাটাতে হয়েছে৷ কতোবার চেয়েছো কথা বলতে পারো নাই কতো বার মন খারাপ হয়েছে কিন্ত পারো নাই সেগুলো মায়ের সাথে শেয়ার করতে ৷ কি করে শেয়ার করতে তখন তো মোবাইল ফোন ও ছিলো না৷ আমি তোমাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী আমার বাচ্চারা৷ love you my baby. mom love you very much.আমার ইউনিটের সহকর্মী যোদ্ধারা আমি তোমাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী ; কারণে অকারণে হয়তো তোমাদের সাথে কটু কথা বলেছি, বকা দিয়েছি কিন্তু আমি জানি তোমরা এটাও জানো আমি তোমাদেরকে অনেক অনেক ভালবাসি৷ আমার বন্ধুবান্ধব, শুভানুধ্যায়ী, পরিচিত, অল্প পরিচিত , কাছের , দুরের আর আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় মানুষ তোমরা সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিও৷ জেনে না জেনে, বুঝে না বুঝে যদি কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকি তবে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন সবাই৷ সবাই ভালো থাকুন, সুস্হ থাকুন, ঘরে থাকুন৷