মঙ্গলবার, বিকাল ৪:১০, ২রা বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মঙ্গলবার, বিকাল ৪:১০, ২রা বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কোরান দর্শন, লাইলাতুল কদর

সদর উদ্দিন আহ্‌মদ চিশতী

লাইলাতুলকদর অর্থ কদর রাত্রি। এলহাম অথবা রুহ নাজেল হওয়ার মত উপযুক্ত পরিশুদ্ধ মানসিক পরিবেশকে কদর রাত্রি বলে। #কদর অর্থ (আত্মিক) শক্তি ও সম্মান। বস্তুমোহের ভিড় হইতে মনের মুক্ত পরিবেশকে কদর রাত্রি বলা হইয়াছে। ইহা রূপক প্রকাশ। বস্তুর অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও রাত্রির কারণে যেমন সেইগুলি চোখে পড়ে না, অন্ধকার আচ্ছন্ন থাকে সেইরূপ সরল পরিশুদ্ধ শক্তিশালী মন বস্তুজগতের অস্তিত্বকে আপন শুদ্ধিদ্বারা মনের পরিবেশের মধ্যে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে। অর্থাৎ মনকে সম্পূর্ণ মোহমুক্ত রাখে। স্বর্গীয় রহমত ও বরকত এই অবস্থাতেই নাজেল হয়।। #সূরাক্বদরএরভাবনুবাদঃ ১. নিশ্চয় আমরা ইহাকে উদয় করিয়া দেই শক্তিশালী রাত্রিতে। ২. এবং তোমাকে কিসে জ্ঞান দিবে ক্বদর রাত্রি কি? ৩. ক্বদর রাত্রি হাজার মাস হইতে উত্তম (কল্যাণপ্রসু) অথবা- বস্তুবাদের মধ্যে তৃষ্ণাময় অবস্থায় রাজি হইয়া থাকা অপেক্ষা ক্বদর রাত্রি উত্তম। ৪. ইহার মধ্যে মালায়কা এবং রুহ নাজেল হয়, তাহাদের রবের (আজান দ্বারা) অনুমতিতে প্রত্যেকটি আমর (Command) হইতে (শান্তি); ৫. শান্তিঃ ইহা ফজরের উদয় পর্যন্ত।
#ব্যুৎপত্তিগতশব্দার্থতথাভাববাদী_শব্দার্থ
#নাজেল= অর্থ অবতারণ, উদয়।
বাংলা অবতারণ শব্দটি খুবই সার্থক সুন্দর। নিম্নমানের লোকদিগকে উচ্চে তুলিয়া ধরিবার জন্য উচ্চমান হইতে নিম্নে নামিয়া আসাকে অবতরণ বলে। বিষয়ের উপর সালাত করিলে নিজ হইতে যে শক্তির উদয় হয় অর্থাৎ ওহি হয় তাহাই ‘নাজেল’
(বা অবতীর্ণ)।।

হু = নিজের ভিতরের পুরুষ সত্ত্বা বা আপন প্রভু তথা আপন আল কোরান। গুরুগণের প্রচেষ্টাতেই বা সহায়তায় এই পুরুষ সত্ত্বা ভক্ত সাধক হইতে উদয় হইয়া উঠে।।

কদর= সমূহ ধর্মের প্রতি ধ্যানকর্মে রাজি থাকিয়া অর্থাৎ সালাতে রাজি থাকিয়া শক্তিমান হওয়া।

লাইলাতুল_কদর= গভীর একাগ্র চিত্ততা বা একাগ্র ভাবনা।

খায়রুন= কল্যাণকর, কল্যাণপ্রসূ।

আলফে= গায়রাল্লাহর মধ্যে থাকিয়া বস্তুবাদে ডুবিয়া থাকা, হাজার; বস্তুবাদে ভালবাসা।

শাহার= হাজার মাস; শেরেকের হেদায়েতের রাজি থাকা; কর্মজ্ঞানতৃষ্ণা অর্থাৎ যে কোন বিষয়ের জ্ঞানতৃষ্ণা।

আলফে_শাহারঃ হাজার মাস। শিরিক পরিচালনার তৃষ্ণায় ভালবাসা। love of pleasing guidence of sirk.

মালায়েকাত= শক্তিশালী সত্ত্বা, মুলকিয়াত যাহার অর্জিত হইয়াছে।

রুহ= প্রজ্ঞাবান , আপন আলোকিত সত্ত্বা।রুহ= প্রজ্ঞাবান সত্তা, আপন আলোকিত সত্তা।‘সাধক-নফস’ এর উপরে নুরে-মোহাম্মদীর মূর্ত অবতরণকে রুহ বলে। রুহ নাজেল হইলে উহা নফসের উপর কর্তা হইয়া যায়। রুহ সৃষ্টির অন্তর্গত নহে, উহা সৃজনী শক্তির অধিকারী। রুহ রহস্যময়। উহার পরিচয় ভাষায় ব্যক্ত করা দুরূহ। রুহ প্রাপ্তি দ্বারা আত্মপরিচয়ের পূর্ণতা আসে। প্রভু গুরুর ভাবমূর্তি (Image of Lord Guru) সাধকের আপন চিত্তের উপর অধিষ্ঠানকে ‘রুহ নাজেল’ বলে। রুহ মূর্তিমান বা মূর্তি হইয়া উঠিলে তাহাকে হুর বলে। হুর আপন আলোকিত পরিশুদ্ধ অবয়ব, যাহা নিজের মধ্যে প্রচ্চন্ন রহিয়াছে। ইহা আল্লাহ্‌র নূররূপে মূর্তিমান হইয়া উঠিলে তাহাকেই হুর বলে। এক কথায় মানব অন্তর নিহিত রুহের মূর্তিমান আত্মপ্রকাশকে হুর বলে। হুর দর্শন আত্মদর্শনের নামান্তর।সুফিগণ মনে করেন গুরুর চেহারা, গুরুর ভাব এবং গুরুর বানী যখন কোন সাধক চিত্তে অঙ্কিত হয় তখন তাহাকে রুহ বলে। অর্থাৎ গুরু-চেহারা, গুরুভাব, এবং গুরুবানী যে শক্তিরূপে সাধকচিত্তে অঙ্কিত হইয়া আসে তাহাকে রুহ বলে। অপরপক্ষে সাধকচিত্তে রুহরূপে অঙ্কিত ভাব যখন সাধকের প্রতিটা কর্মধারায় বাস্তব রূপ নেয় তখন সেই সাধককেই ‘হুর’ বলা হয়।।

আমর= কর্ম, নির্দেশ, command. যে সত্ত্বা তাহার শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের কারণে তার সব কাজকর্ম, আচরণ-বিচরণ তাহার চারিপাশে সবার উপরে খুব গভীর রেখাপাত করে তাহার সমস্ত আচরণ-বিচরণকে আমর বলে এবং তাহাকে আমির বলে। এই আমর জ্ঞানময় আমর। চরম পরম “আমি” এর উপরে অন্য কথায় আল্লাহর উপরে তন্ময় হইয়া থাকার রাজি অবস্থায় যে কর্মাদি প্রকাশিত হয় তাহাই আমর। এইরূপ আমর যিনি করিতে পারেন তিনি আমির। এই আমর শুধু আলিগণই করিতে পারেন।।

ফজর= ঊষাকাল; পাপ, গুনাহ। কি রকম পাপ? মন- মস্তিষ্ক মোহ সঞ্চয়ের বৃদ্ধিতে রাজি থাকা বা সন্তুষ্ট হইয়া থাকাই পাপ। এইরূপ পাপ করা মানুষের স্বভাব ধর্ম। অথচ মোহ কালিমা সকল পাপের উৎস। সালাত কর্ম দ্বারা এই অপরাধ হইতে তথা এই বন্ধন হইতে মুক্তি লাভ করা যায়।

‘ফজর’ বৃদ্ধির রাজির মধ্যে অর্থাৎ অজ্ঞান অবস্থা মধ্যে। যাহা বৃদ্ধিময় তাহাই মন্দ। জ্ঞানেরও বৃদ্ধি আছে অজ্ঞানতারও বৃদ্ধি আছে, পরিণামে উভয়ই পরিত্যাজ্য।।
‘#ফে’ অক্ষর দ্বারা বুঝায় মধ্যে, ‘#জিম’ অক্ষর দ্বারা বৃদ্ধি এবং ‘#রে’ অক্ষর দ্বারা রাজি। মন-মস্তিষ্কে সঞ্চিত মোহ বৃদ্ধির মধ্যে রাজি বা সন্তুষ্ট হইয়া থাকা অবস্থাকে ফজর বলে। ইহা হইতে কদর রাত্রি উত্তম । অর্থাৎ বিষয়মুগ্ধ অবস্থা হইতে মুক্তির লক্ষে ধ্যানমগ্ন কদর অবস্থা উত্তম। আদম্য মনকে দমন করিবার ইহাই সর্বশ্রেষ্ঠ পদ্ধতি।

আজান= অধিকার প্রাপ্ত অবস্থায় ঘোষণা। এই ঘোষণা বা আহ্বান আপন রব হইতে অনুমতি এবং অধিকার প্রাপ্ত আহ্বান। আপন রব হইতে অর্জিত মহাজ্ঞানভাণ্ডার হইতে জ্ঞান বিতরণ করিবার জন্য জনগণকে আহ্বান করিতে হয়। নিজে স্বর্গীয় মহাজ্ঞানের অধিকারী না হইয়া আগুত ব্যক্তিগণকে মুল্যবান কিছুই দান করা যায় না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যাইতে পারে যে, আল্লাহ তা’লা নবিবর ইব্রাহীমকে (আ) জ্ঞান দান করিবার পর সেই জ্ঞান জনগণকে দান করিবার উদ্দেশ্যে তাঁহার দিকে আজান দিতে অর্থাৎ জনগণকে আহ্বান করিতে বলিলেন(২২ঃ২৭ দ্রষ্টব্য।) মোমিন ব্যতিত আল্লাহর পথে আহ্বান করিবার মৌলিক অধিকার কাহারও নাই।।

                     #সূরা_কদর_এর_ব্যাখ্যাঃ 

১. নিশ্চয় ‘প্রভুত্ব এবং প্রজ্ঞা’ অর্থাৎ বিষয়ের উপরে তথা দুনিয়ার উপরে প্রভুত্ব এবং প্রজ্ঞা উদয় হয় গভীর এবং ভাবনার মধ্যে (অর্থাৎ সালাতের মধ্যে)
২. একাগ্র ভাবনা কি? ইহা সাধককে কিসের দ্বারা বুঝান যাইবে? (একাগ্র ভাবনা বিষয়টি সম্যক গুরু ছাড়া কথায় বুঝান যাইবেনা। গুরুর গুণগ্রাম দেখার মধ্যে এই জ্ঞান নিহিত থাকে। সেইজন্য একাগ্র ভাবনাটা কি সেই প্রশ্ন করিয়াও উত্তর রাখা হয় নাই)।
৩. #একাগ্র_ভাবনাঃ অজ্ঞান এবং বস্তুবাদে থাকা অপেক্ষা অনেক কল্যাণকর। মহা আমি’কে তথা আল্লাহকে নফি করিয়া অর্থাৎ নিজের মধ্যে জাগ্রত না করিয়া সর্বরকম আনুষ্ঠানিকতা ও কর্মবাদে লিপ্ত থাকা অপেক্ষা একাগ্র ভাবনা কল্যাণকর। বস্তুবাদের মধ্যে তৃষ্ণাময় অবস্থায় রাজি হইয়া থাকা অপেক্ষা উত্তম।
৪. #ইহাতে (অর্থাৎ একাগ্র ভাবনাতে) সর্বরকম বিষয়ের উপরে স্থায়ী প্রভুত্ব এবং প্রজ্ঞা বা রুহ উদয় হয়। অধিকারে আসা সর্বরকম সংস্কারের প্রত্যেক (রেখাপাতকারি) অবস্থা হইতে উদয় হয়।
৫. #ইহাতে রহিয়াছে শান্তি। এই শান্তি বিরাজ করিবে যতক্ষণ পর্যন্ত না একাগ্র ভাবনা ছুটিয়া গিয়া অজ্ঞানতাতে লিপ্ত না হয়।

সূরাক্বদরএরসারকথাঃ সুরাটি সাধকের সালাতের মহাকল্যাণকর বৈশিষ্ট্যের দিকে সাধকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হইয়াছে। সালাতের মাধ্যমে সর্ব বিষয়ের উপরে বা দুনিয়ার উপরে স্থায়ী প্রভুত্ব ও প্রজ্ঞা উদয় হয়। এবং তাহাতে রহিয়াছে শান্তি।

একটি_কথাঃ

কোরানের ব্যবহৃত বিশেষ বিশেষ শব্দগুলি উহাদের অক্ষর অনুসারে বিশেষ একটি গভীর জীবনদর্শনমূলক ইঙ্গিত বহন করে। সকল ধর্মীয় সাহিত্যে এইরূপ একটি বৈশিষ্ট্য থাকে। এই বৈশিষ্ট্যের পরিচয় না থাকিলে ধর্মীয় সাহিত্য হইতে গভীর জীবনদর্শন উদ্ধার করা যায় না। এই কারণে কোন ধর্মগ্রন্থই সাধারণ জনগণের পাঠযোগ্য গ্রন্থ নয়। সাধারণ জনগণ পাঠ করিবে আপন আপন গুরুকে। গুরুপাঠে অগ্রসর হইলে জীবনগ্রন্থ পাঠ তথা ধর্মগ্রন্থ পাঠ বোধগম্য হইয়া থাকে।।

একটি_মন্তব্য

সারাবছর মামুলি জীবন কাটাইলেও বিশেষ বিশেষ দিনগুলিতে এবাদত এবং সৎ আমল করিলে অসীম সওয়াব পাওয়া যায়। যথাঃ-শবে বরাত, শবে কদর, শবে মেরাজ, আশুরার দিন ইত্যাদি ইত্যাদি। এইরূপ ব্যবস্থাগুলিকে জুয়ারি-মন সুলভ ব্যবস্থা Gambler’s attitude and prescription বলা যায় মাত্র। এর উদ্দেশ্যও কোরানের বিঘোষিত মূলনীতিকে খণ্ডন করা।

টীকাভাষ্যঃ সওয়াব’ দুই পর্যায়ভুক্ত, দুনিয়ার সওয়াব এবং আখেরাতের সওয়াব (৩ঃ১৪৬-১৪৭ দ্র.)। দুনিয়ার জীবনে দোষত্রুটি ক্ষমা করা, সকল কর্ম ও কথা মধ্য হইতে বৃত্তির অপচয় ক্ষমা করা , সত্যের উপর দৃঢ়ভাবে পদ প্রতিষ্ঠা করা, কাফের কাওমের উপর বিজয়ী হওয়ার সাহায্য দান করা ইত্যাদি হইল দুনিয়ার সওয়াব।।

আল্লাহ যে সকল গুণ মানুষ আপন রব হইতে অর্জন ক্রিয়া লয় সেই সকল গুণ মানব চরিত্রে স্থায়িত্ব লাভ করে তখন উহাকে আখেরাতের সওয়াব বলে। সওয়াব সাধকের জীবনের মুলধন। উহার সাহায্যে যাহা যখন প্রয়োজন তাহা আপন রবের অনুমোদনে ইচ্ছামত উৎপাদন করিয়া লইতে পারে। আপন রব নিজেই উত্তম সওয়াব এবং উত্তম প্রত্যাবর্তন বা পরাবৃত্ত। জন্মান্তরে বারে বারে রবের দিকে ফিরিয়া আসা ভাল নহে। তাহাকে পুরষ্কার রূপে পাইলে উহা উত্তম। তিনি উত্তম পুরষ্কার দ্র.-(১৮ঃ৪৪-৪৬), (১৯ঃ৭৫)।


যেকোন ব্যক্তির জন্য কোরান বুঝার
উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হইলঃ
কোরান না পড়িয়া আত্মিক সাধনার সাহায্যে বুঝিয়া লওয়া। যেমন-বুঝিয়া থাকেন সত্যের সাধকগণ। সাধনার বিশেষ পর্যায়ে- যেমন কদর রাত্রিতে সাধকের উপর কোরান জ্ঞান নাজেল হইয়া থাকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top