বৃহস্পতিবার, দুপুর ২:৫৮, ৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বৃহস্পতিবার, দুপুর ২:৫৮, ৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আহা! গভর্ধারণ

কেকা অধিকারী

নীড় অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম আমরা বিশটি পরিবার। সবাই ফ্ল্যাটের মালিক। শুধুৃমাত্র দোতলার চার ফ্ল্যাটের  মধ্যে দুই  ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ছিলো ভাড়াটিয়া। এই দুই ভাড়াটিয়ার একটি ছিলাম আমরা আর অন্যটি আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের দম্পতি। স্বামী-স্ত্রী  মিলে দুজনের সংসার ছিল তাদের। অন্যদিকে চাকরি, সামাজিক-সাংগঠনিক ব্যাস্ততা আর স্বভাবগত কারণে প্রতিবেশী কারো বাসাতেই যাতয়াত ছিল না আমার। শুধু জানতাম পাশের ফ্ল্যাটের ভীষণ মিষ্টি চেহারার শ্যামলা ভদ্রমহিলা একজন শিক্ষক আর তার স্বামী একজন ব্যবসায়ী। সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার সময় কালে ভদ্রে আমার দেখা হতো ভদ্রমহিলার সাথে। সেটা ছিলো মার্চ মাসের প্রথম  সপ্তার কোন একদিন।।তখন আমার প্রেগন্যান্সির পাঁচ মাস চলছিল। এমন সময় অ্যাপার্টমেন্টের মহিলা কমিটি তলব করল  তাদের একটি সভায় যোগ দিতে। সভায় যোগ দিয়ে জানলাম আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে নারী দিবস উদযাপন করা হবে।  সে উপলক্ষে প্রথম পর্বে হবে কিছু কথা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং দ্বিতীয় পর্বে থাকবে প্রীতি ভোজ। পরিকল্পনা হলো বিশটি পরিবারের সব সদস্যই সন্ধ্যাবেলার এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হবে এবং আমরা সবাই মিলে এক সাথে রাতের খাবার খাবো। সে সভাতেই অ্যাপার্টমেন্টের আগ্রহী নারীদেরকে নিয়ে আমাকে প্রথম পর্ব আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হলো।  দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিল্ডিং এর গুনী গুনী সুন্দর মেয়েদের সাথে ঘনিষ্ঠতা হলো আমার। গান,  নাচ ও অভিনয়ের রিহার্সাল চললো আমার আরেক প্রতিবেশী শেফালী মাসির বাসায়। ঐ প্রথম আমি মাসির ঘরে গিয়েছিলাম। পরিচয় হলো আগে থেকে কৌতুহল সৃষ্টি করা মাসির বড় ছেলে বাবুর বউ ন্যান্সির সাথে।  ওকে নিয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছিল একটি কারণে – হলিক্রস কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়া ন্যান্সি সব সময় শাড়ি পরে থাকতো। আমি খুব অবাক হতাম ওকে ঐ পোশাকে দেখে। এতো অল্প বয়সে আজকাল মেয়েদের বিয়ে হয়! মাসি সে সময়ই আমার গর্ভধারণ সংক্রান্ত সব খুঁটিনাটি জেনে নিয়েছিলেন।  সেই থেকে তিনি আমার ও আমাদের পরিবারের আপনজন হয়েছেন। মাসীর স্বামী  অনিল মেসো সে সময়ে প্রবাসী ছিলেন। ফ্ল্যাটটিতে মাসীর সাথে আরও ছিল  তাদের দু’ছেলে বাবু, দেবু যারা তখন থেকে আমার ভাই, আর বাবুর স্ত্রী ন্যান্সি। অন্বয়কে জন্ম থেকে এ পর্যন্ত বড় করতে এ পরিবারটির সহোযোগিতার ঋন কোনদিনও শোধ করতে পারব না।   যাক সেই নারী দিবসের অনুষ্ঠানে ফিরে আসি। বিল্ডিং এর নিচ তলায় ডেকোরেটরের চেয়ার টেবিল ভাড়া করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো।  অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলাকালে প্রতিবেশীরা আমার কনসিভ করার কথা জেনেছিলেন।  তবে  কোন কারণে তখনও খবরটা আমার পাশের ঘরের মিষ্টি ভদ্রমহিলার কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি।  মনে আছে আমি সে অনুষ্ঠানে নারী দিবস নিয়ে দু’একটা কথা বলেছিলাম। কথা বলা শেষে দর্শক সারিতে বসা প্রতিবেশী মহিলার  পাশে গিয়ে বসেছি। অনুষ্ঠান দেখার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক কথা হচ্ছিল আমাদের দু’ জনের। এমন সময় আমাদের পিছনের সারিতে বসা আরেক জন মহিলা আমার কাঁধ স্পর্শ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। আমি তার দিকে ফিরে তাকালাম। তিনি আমাকে সম্তান ধারণের জন্য অভিনন্দন জানালেন। পাশে বসা ভদ্র মহিলা এবার  আমার গর্ভধারণের খবরটা জানতে পেলেন।

  • দিদি, আপনি কনসিভ করছেন?
  • হ্যাঁ। আপনি আগে জানতেন না?
  • না, জানতাম না। কয় মাস হলো?
  • এই তো পাঁচ মাস। 
  • কয় বছর হলো আপনাদের বিয়ে হয়েছে? 
  • প্রায় তিন বছর। 
  • হ্যাঁ, অনেক ভালো একটা খবর।  

টেনে টেনে কথাগুলি বললেন তিনি। আমি তার চোখে মুখে হঠাৎ একটা অস্থিরতা দেখতে পেলাম।  কী হলো তার বুঝতে না পেরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছু সময় পরে তিনি নিজে আমাকে তার কারণ বললেন, অবশ্য পুরোটাই এলোমেলো ভাবে- 

  • দিদি আপনি কনসিভ করছেন, কত আনন্দের খবর।… আমার ভালো লাগা উচিত।…. কিন্তু কি জানেন খবরটা শুনে আমার যেন কেমন লাগছে।… আমার না অনেক বছর হইছে বিয়ে হইছে…… কতো চেষ্টা করি….আমার সমস্যা আছে…. হয় না…. আমার স্বামী…. 

ভদ্রমহিলার গলা বুজে এসেছিল। মনে হলো চোখ গড়িয়ে তার জল পরছে। এ অবস্থায় আমি তাকে কী বলবো, আমার তাকে কী বলা উচিত বুঝে উঠতে পারছিলাম না।  আমি কী তাকে সান্ত্বনার কথা বলবো?  আমার গর্ভধারণ কাউকে এমন করে কষ্ট দিতে পারে সে তো আমি স্বপ্নেও ভাবিনি! যে মানুষটা আমাকে দেখে কষ্ট পাচ্ছে আমার কোন কথা কি তাকে সান্ত্বনা দিতে পারে? আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না।  তাছাড়া এতো মানুষের মধ্যে বসে কীই বা বলতে পারি?  এ সব ভাবতে ভাবতে আমার মুখ দিয়েও কিছু বিছিন্ন শব্দ বেরিয়ে এসেছিলো নিশ্চয়। সে জন্য আশে পাশের চেয়ারের কয়েকটি চোখ কৌতুহলী হয়ে উঠেছিলো আমাদের বিষয়ে।  আমার মনে আছে আমি আমার বাম হাত দিয়ে পাশে বসা মানুষটিকে জড়িয়ে ধরেছিলাম আর ডান হাত দিয়ে চেপে ধরেছিলাম তার কোলের উপর ফেলে রাখা ডান হাতের আঙুলগুলি। মুখে অবশেষে বলতে পেরেছিলাম- দিদি, আমার বাচ্চাকে আপনিও নিজের বাচ্চা মতো ভালোবাসবেন, কাছে নেবেন। আমি কিছু মনে করবো না।  তবে আমার ছেলে অন্বয় হওয়ার পরে আমরা যতোদিন পাশাপাশি ছিলাম তিনি কোনদিনও ওকে সেভাবে কাছে টেনে নেননি।  তা কি সেদিনের কথা ভেবে লজ্জায়?  নাকি ভাগের সন্তান তিনি চাননি বলে?  নাকি উনি জানতেন যে, মুখে বললেও নিজের ছেলেকে আমি সেভাবে তাকে দিতে পারবো না।  সত্যি উত্তরটা  আমার আজও অজানা।   

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top