বৃহস্পতিবার, সকাল ১১:১৯, ৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বৃহস্পতিবার, সকাল ১১:১৯, ৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভালোবাসার মৃত্যু হয় না, হত্যা করা হয়

সামসুন নাহার

মিলা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে, কিন্তু তার চোখে কোন উচ্ছ্বাস নেই। সে মলিন হাসিতে আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে, অস্ফূট স্বরে বলল, “তুমি খেয়াল করেছ! আগে একদিন আমার প্রশংসা না করলে আমি ভীষণ অভিমান করতাম, আর এখন আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজেই বলি—মিলা, তুমি সুন্দর!” বলেই ফিক করে হেসে দিল। বুক ভারি হয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

মিলা আর তাহমিদের সংসার জীবনটা একসময় ছিল সুখময় স্বপ্নের বুননে গাঁথা গল্পের মতো। প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার আগে তাহমিদ মিলাকে একটা চুমু দিয়ে, বলত, “তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মানুষ।”

অফিস থেকে ফেরার পথে মিলার জন্য ছোট্ট চকলেট কিংবা একটা ফুল নিয়ে আসা ছিল তার প্রতিদিনের অভ্যাস। সপ্তাহান্তে একসঙ্গে লং ড্রাইভে যেত, কোনো কারণ ছাড়াই বলত, “তুমি অনেক সুন্দর, জানো?

রাতে একসঙ্গে বসে গল্প করা, কোনো উপলক্ষ ছাড়াই সিনেমা দেখতে যাওয়া—সবই ছিল তাদের সম্পর্কের সহজাত সৌন্দর্য। তাহমিদ ভালোবাসতে জানত, যত্ন নিতে জানত।

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব বদলে যেতে লাগলো। আজকাল অফিস থেকে ফিরেই মোবাইল নিয়ে পরে থাকে, ক্লান্তির অজুহাতে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। মিলা অপেক্ষা করে, তাহমিদ খেয়াল করবে তার অভিমান, তার চুপ থাকা। কিন্তু না, তাহমিদের এদিকে কোন নজর নেই।

জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকীর মতো বিশেষ দিনগুলোও ভুলে যেতে লাগল। মিলা প্রথমে কষ্ট পেত, নিরবে চোখের পানি ফেলত। ধীরে ধীরে সে নিজেকে বোঝাতে লাগল, “ভালোবাসা হয়তো এমনই। সময়ের সাথে ম্লান হয়ে যায়।”

আজ তাদের দশম বিবাহ বার্ষিকী। নতুন শাড়ি পরে, একটু অন্যরকম সাজও করেছে। সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, তাহমিদ এই দশম বছরটিকে ভুলবে না। সে আসবে, খেয়াল করবে, হয়তো বলবে তোমাকে খুব ‘সুন্দর লাগছে’। কিন্তু তাহমিদ ঘরে ঢুকে মোবাইল নিয়ে একইভাবে ব্যস্ত হয়ে গেল, একবার তাকাল, তারপর বলল, “খুব গরম লাগছে, এসিটা বাড়িয়ে দাও।”

মিলা কোনো কথা বলল না। সে বুঝতে পারল, তার প্রতীক্ষা বৃথা। যে সম্পর্ক একসময় ফুলের মতো সতেজ ছিল, সেটাকে সে একা আগলে রেখেছে, আর তাহমিদ ধীরে ধীরে সেই ফুলের সব পাপড়ি শুকিয়ে দিয়েছে। যে ভালোবাসা একসময় জীবনের প্রাণ ছিল, সেটাই আস্তে আস্তে জীবন যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠলো। সেদিনের পর থেকে থেকে মিলা আর কোনো অভিযোগ করত না, অপেক্ষা করতো না। তাহমিদ দেরি করে বাসায় ফিরলেও জিজ্ঞেস করত না, ফোনে ডুবে থাকলেও কিছু বলত না। সে বুঝতে শিখেছিল, কিছু জিনিস জোর করে ঠিক করা যায় না। মিলা বুঝেছিল, নিজেকে ভালো না বাসলে কেউ তাকে ভালোবাসবে না।”

এরপর থেকে মিলা নিজের প্রতি যত্ন নিতে শুরু করল, নিজেকে ভালোবাসতে শিখল। একদিন রাতে তাহমিদ খেয়াল করল, মিলা বারান্দায় বসে নিজের পছন্দের বই পড়ছে, কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। তার মুখে একধরনের প্রশান্তি, কিন্তু সেই উচ্ছ্বাস নেই, যেটা একসময় তাহমিদ শুধু তার জন্যে দেখতে পেত। সেদিন রাতে তাহমিদ বলল, “কাছে এসে বসো, অনেকদিন তো ঠিকমতো কথা বলা হয় না। আজকে রাতে গল্প করি।” মিলা হাসল, বলল, “তাহমিদ, আমি অনেকদিন ধরেই চাইছিলাম আমরা কথা বলি, কিন্তু তুমি তো ব্যস্ত থাকো। এখন আর দরকার নেই। মিলা এবার গভীরভাবে তাকাল তাহমিদের দিকে। “তুমি বুঝতে পারোনি, বেশ কয়েক বছর ধরে প্রতিদিন একটু একটু করে তুমি আমাকে হারিয়ে ফেলেছ। আমি একা থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তোমার সঙ্গে থাকা এখন আর আমার কাছে স্বস্তির কিছু নয়।” তাহমিদ কপাল কুঁচকে বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, তুমি হঠাৎ একি কথা বলছ মীলা? মিলা মৃদু হেসে বলল, “হঠাৎ! না, এটা হঠাৎ না। তুমি অনেক দিন ধরে আমাকে একা করে দিয়েছ, আমি শুধু নিজেকে বুঝিয়ে এসেছি। যে সম্পর্কের যত্ন নেয়া হয় না, সেটা টিকে থাকে না। ভালোবাসাও তেমনই। তুমি ধীরে ধীরে আমাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছ, যেখানে তোমার অনুপস্থিতি আমাকে আর কষ্ট দেয় না।” একসময় তোমার অবহেলা সহ্য করতাম, একান্তে তোমাকে না পাওয়ার কষ্ট লালন করতাম। কিন্তু এখন আর করি না। তাহমিদের কিছু বলার ছিল না। সে এতদিন ধরে যে সম্পর্কটাকে অবহেলা করে আসছিল, সেটা যে কবে কখন নিঃশেষ হয়ে গেছে, সে নিজেও জানত না। সে বুঝল, এতদিন ধরে সে শুধু ধরেই নিয়েছিল যে, মিলা তার জন্য সবকিছু করবে, অপেক্ষা করবে, অভিমান করবে। কিন্তু সে কখনো ভাবেনি, একসময় অভিমানও শেষ হয়ে যায়, মানুষ ক্লান্ত হয়ে যায়।

তাহমিদ মিলার চোখে যেটা দেখল, তা অপরিচিত! এ চোখ অভিমানী নয়, কান্নাভেজা নয়—এ চোখ শক্ত, সিদ্ধান্ত নেওয়া এক নারীর! ভালোবাসা শুধু অনুভূতি নয়, যত্নের অভ্যাস। মিলা এখন তাহমিদকে ছাড়া বাঁচতে শিখে গেছে। আসলে মানুষ হুট করে বদলায় না, ভালোবাসাও একদিনে শেষ হয়ে যায় না। অবহেলা আর উদাসীনতা প্রতিদিন একটু একটু করে ভালোবাসাকে মেরে ফেলে। সম্পর্ক, যত্ন না পেলে, একসময় সেটা নিঃশেষ হয়ে যায়… অনেকদিন পর তাহমিদ অনুভব করল মিলা অভিমান করাও ছেড়ে দিয়েছে। তাদের সম্পর্ক আবার আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে কিনা … সে সত্যিই ফিরে আসতে চায়। তবে বুকে ধুকপুক বাড়ানো একটি শঙ্কা দুমরে মুচড়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাহমিদ এখন জানে না সেই জায়গাটি তার জন্যে আজও খালি রয়েছে কিনা…

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top