মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ৭৬ বছর পার করে ৭৭ বছরে পদার্পণ করতে চলেছে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সিপিবি হলো প্রাচীনতম দল। এই দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ারও আগে। অনেকে অবশ্য বলতে পারেন যে আওয়ামী লীগের তো জন্ম হয়েছিল মুসলিম লীগের গর্ভে এবং সেই দলটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯০৬ সালে, ১১৮ বছর আগে। সুতরাং আওয়ামী লীগই হলো দেশের প্রাচীনতম দল। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে একথা স্বীকার করে নিতে হবে যে, মুসলিম লীগের গর্ভজাত সন্তান হিসেবে সে তার প্রতিক্রিয়াশীল-সাম্প্রদায়িক চরিত্রের নানা উপাদান জন্মচিহ্ন সরূপ বহন করে চলছে। সে কথা যে সত্য তা আমরা বাস্তব ঘটনায় প্রমান পেলেও, তাতে বিব্রত বোধ করতো আওয়ামী লীগ তা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চায় না। এদিকে, দেশের প্রাচীনতম দল বলে আওয়ামী লীগের দম্ভ অনেকটাই ফিঁকে হয়ে যাওয়ার কারণ হলো- আমাদের দেশে কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রমও শুরু হয়েছিল কাছাকাছি ১০৪ বছর আগে ১৯২০ সালে। সিপিবি কিন্তু তার সেই জন্ম বৃত্তান্তকে অস্বীকার করে না, বরঞ্চ তার শতাব্দিকালেরও অধিক সময়ের অস্তিত্বের সামগ্রিক ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতাকে সে গর্বের সাথে ধারণ করে থাকে। আমাদের দেশে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু হয়ে, প্রায় তিন দশক ধরে বৃটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতে তার কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার পর, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ায় নবগঠিত পাকিস্তানে ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ স্বতন্ত্রভাবে পৃথক কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করা হয়েছিল। সেই পার্টিরই নাম এখন ‘বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি’ বা সিপিবি। সেই হিসেবে সিপিবির বয়স এখন ৭৭ বছর হতে চলেছে। এই পার্টির সাথে আমার সংশ্লিষ্টতা ৫৯ বছরের। আমার কাছে এই সংশ্লিষ্টতা পরম গৌরব ও সম্মানের। অবিভক্ত ভারতে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষ ও জনগনের ভাত-কাপড়-রুটি-রুজি-অধিকারের জন্য সংগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টি শুরু থেকেই অগ্রনী ভুমিকা পালন করেছে। একই সাথে সে দেশের স্বাধিনতা সংগ্রামকে ‘স্ব-শাসন’, ‘স্বরাজ’ ইত্যাদি দাবি থেকে ‘পূর্ণ স্বাধিনতার’ দাবিতে উত্তোরন ঘটাতে এবং স্বাধিনতা সংগ্রামে শ্রমজীবী মানুষ সহ আপামর জনগনকে সম্পৃক্ত করতে কেন্দ্রীক ভুমিকা পালন করেছে। কিন্তু জাতীয় আন্দোলনে আধিপত্ব বিস্তারকারী বুর্জোয়া নেতৃত্বের দুর্ববলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে, এবং হিন্দু ও মুসলিম সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে ব্যাবহার করে, বৃটিশ শাসকরা তাদের ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতির ধারাবাহিকতায় ভারতকে ভাগ করে দু’টি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে স্বক্ষম হয়। জন্ম হয় নতুন এক কৃত্রিম-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান। পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই পূর্ব বাংলার (পূর্ব পাকিস্তানের) কমিউনিস্টদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি যে, বাঙালি জাতির জাতীয় মুক্তি অর্জন অপূর্ণই থেকে গিয়েছিল। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকরা বিদায় নেয়ার আগে সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির মাধ্যমে বিভেদের বিষ গলাধঃকরণ করতে বাধ্য করেছিল। গোটা উপমহাদেশে এভাবে তারা তাদের আধিপত্য ও প্রভাব বহুলাংশে অটুট রাখার ব্যবস্থা করতে পেরেছিল। ফলে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের হাত থেকে জাতীয় মুক্তির অনেক কর্তব্য অনার্জিত থেকে গিয়েছিল। তা ছাড়া, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার (পূর্ব পাকিস্তানের) ওপর বৈষম্য ও বাঙালি জাতিসত্তার বিরুদ্ধে নির্মম জাতিগত শোষণ চাপিয়ে দিয়েছিল। এভাবে বাঙালির ওপর চেপে বসেছিল আরেকটি নতুন ঔপনিবেশিক ধরনের শোষণ। দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’ স্লোগান দিয়ে গোটা উপমহাদেশে সশস্ত্র অভ্যুত্থান সংগঠিত করার পথে অবতীর্ণ হয়েছিল। এ কথা ঠিক যে, এটি ছিল কমিউনিস্টদের বাম-হঠকারি বিচ্যুতির প্রকাশ। ভারতের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলার পরিস্থিতির আলোকে এই ভুল লাইনের মধ্যেও এক গভীর সত্য অন্তর্নিহিত ছিল। পাকিস্তানের আজাদি যে ‘ভুয়া আজাদি’ – কমিউনিস্টরা তা ১৯৪৮ সালেই ঘোষণা করেছিল। পাকিস্তান যে একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র, এবং এ ধরনের কৃত্রিম রাষ্ট্র যে চিরস্থায়ী হতে পারে না – শুরু থেকেই সেই উপলব্ধি কমিউনিস্টদের মধ্যে কম বেশি ছিল। সাম্রাজ্যবাদী ও পশ্চিম পাকিস্তানি (পাঞ্জাবি) একচেটিয়া ধনিক শ্রেণির শোষণকে একচ্ছত্র ও অবাধ করার জন্য পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-জাতীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রভৃতির বিরুদ্ধে হিংস্র আক্রমণ চালিয়েছিল এবং সূচনা করেছিল জাতিগত শোষণ, বৈষম্য ও নিপীড়নের এক নিষ্ঠূর অধ্যায়। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো পদদলিত করে এক ধরনের ফ্যাসিস্ট শাসনে জাতিকে আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি এসবের বিরুদ্ধে প্রায় এককভাবে এক অসীম সাহসী প্রতিরোধের সূচনা করেছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই কমিউনিস্টদের ওপরে নেমে এসেছিল নির্যাতনের কঠোর স্টিম রোলার। পাকিস্তানি শাসকরা নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল, ফ্যাসিস্ট জিগির তুলে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ‘শির কাতাল কর দেঙ্গে’-বলে উন্মত্ত হুংকার দেয়া হয়েছিল। কোনো বিরোধী ওস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করার পথ গ্রহন করা হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসনের এমন ফ্যাসিস্ট রুদ্র রূপের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সে সময় একমাত্র কমিউনিস্টরা ছাড়া আর তেমন কেউ ছিল না। ‘পাকিস্তান জামানার’ সেই অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, শোষণমূলক (জাতিগত ও শ্রেণিগত) অধ্যায়ের সূচনাতে সবচেয়ে আগে নিষ্ঠূর ও বর্বর আঘাত নেমে এসেছিল দৃঢ়চেতা আদর্শনিষ্ঠ কমিউনিস্টদের ওপর। সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির প্রথম দিনগুলোতে নির্যাতন, জেল-জুলুম, হুলিয়া, হামলা-মামলা, হত্যা, নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি উপেক্ষা করে কমিউনিস্টদেরকে প্রায় এককভাবে সূচনা করতে হয়েছিল গণতন্ত্র, জাতীয় অধিকার ও রুটি-রুজির জন্য সংগ্রামের নতুন অধ্যায়। নব পর্যায়ের এই সংগ্রামের প্রথম দিকেই রাজপথে, প্রতিরোধের প্রান্তরে, জেলখানায় শহিদ হয়েছিলেন অসংখ্য কমিউনিস্ট। ‘রানী মা’ বলে খ্যাত কমরেড ইলা মিত্রের নেতৃত্বে নাচোল বিদ্রোহ, বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়া ঐতিহাসিক ‘তেভাগা আন্দোলন’, কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে গারো পাহাড় এলাকার ‘টঙ্ক আন্দোলন’, অজয় ভট্টাচার্য-বারীণ দত্তের নেতৃত্বে সিলেটের ‘নানকার বিদ্রোহ’ – প্রভৃতি জঙ্গি সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বহু কমরেড। ঢাকা জেলে অনশন-সংগ্রামে জীবন দিয়েছিলেন শিবেন রায়। রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে এ দেশের ‘প্রথম জেল হত্যাকাণ্ডে’ শহিদ হয়েছিলেন হানিফ শেখ, বিজন সেন, দেলওয়ার হোসেন, কম্পরাম সিংহ, সুখেন ভট্টাচার্য, সুধীন ধর ও আনোয়ার হোসেন। জেলখানাগুলো ভরে গিয়েছিল কমিউনিস্ট বন্দীদের দ্বারা। সংগ্রাম ও গৌরবের পথে কমিউনিস্টদের পথচলার শুরু হয়েছিল এভাবেই। কমিউনিস্টদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় রুটি-রুজির দাবি সহ নিজ নিজ অধিকার নিয়ে কথা বলার সাহস ক্রমেই গণমানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হতে শুরু করেছিল। গণতন্ত্র, বাঙালি জাতির অধিকার, বিশ্ব শান্তি ইত্যাদি ইস্যুও ক্রমে সামনে আসতে শুরু করেছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের মধ্যে থাকা বাঙালি মধ্যবিত্তের স্বার্থরক্ষাকারী একটি অংশ, বহুলাংশে কমিউনিস্টদের সাহসী প্রয়াসের দ্বারা সূচিত, নব পর্যায়ের এই সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিল। ফলে পরিস্থিতি খুব তাড়াতাড়ি ‘পাল্টে যেতে’ শুরু করেছিল। এই পাল্টে দেয়ার প্রক্রিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির অবদান ছিল অনন্য, ও এক হিসেবে প্রধান। ’৪৮ থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন ও তারপরে ’৫২-এর ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবসের রক্তদানের মধ্য দিয়ে এই ‘পাল্টে দেয়ার’ প্রক্রিয়া অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। ভাষা আন্দোলনে গোপনে তৎপর থেকেও কমিউনিস্ট পার্টির ছিল গুরুত্বপূর্ণ সক্রিয় অবদান। এই আন্দোলনকে সঠিক গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ধারায় অগ্রসর করে নিতে এবং এই আন্দোলনে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করার কাজে কমিউনিস্টদেরই ছিল প্রধান সচেতন রাজনৈতিক ভূমিকা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে একুশের অমর শহীদ বরকত ব্যক্তিগতভাবে কমিউনিস্ট ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া সচেতনতা ও জাগরণকে রাজনীতির অঙ্গনে যথাযর্থভাবে প্রতিফলিত করার জন্য ’৫৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গড়ে উঠেছিল। রচিত হয়েছিল যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক ২১-দফা কর্মসূচি। নির্বাচনে মুসলিম লীগের চরম ভরাডুবি ঘটিয়ে যুক্তফ্রন্ট ৯৮ শতাংশ আসনে জয়লাভ করেছিল। যুক্তফ্রন্ট গঠনে সকলকে রাজি করাতে, ২১-দফা কর্মসূচি রচনায় এবং নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় নিশ্চিত করতে কমিউনিস্ট পার্টির (তা কার্যত নিষিদ্ধ হয়ে থাকা সত্ত্বেও) ছিল অগ্রগণ্য ভূমিকা। একের পর এক ষড়যন্ত্র করেও আন্দোলনের ধারা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানি শাসকরা ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুবী সামরিক স্বৈরতন্ত্রের জালে বাঙালি জাতির সংগ্রামকে অবরুদ্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু জনগনের সংগ্রাম বেশিদিন স্তব্ধ থাকেনি। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবির পাশাপাশি বাঙালির অধিকারের দাবি, সাম্রাজ্যবাদ রুখে দাঁড়ানোর দাবি, শ্রমিক-কৃষকের রুটি-রুজির দাবি প্রভৃতি দাবিতে সংগ্রাম ক্রমান্বয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। সব গণতান্ত্রিক শক্তির ওপর আঘাত এলেও, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, সামরিক আইনে বেত্রদনণ্ড, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে রাস্ট্রিকেশন, হুলিয়া-গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইত্যাদির প্রধান টার্গেট ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি প্রভৃতি বামপন্থি সংগঠনের অকুতোভয়, দৃঢ়চেতা, আপসহীন নেতা-কর্মীরা। সেই সংগ্রামেরও অগ্রভাগে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। ’৬২, ’৬৪, ’৬৬ সালে পরিচালিত হয়েছিল জাতীয় পর্যায়ের সংগ্রামের বড় বড় অধ্যায়। অবশেষে সংগঠিত হয়েছিল ’৬৯-এর ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান। পতন হয়েছিল আইয়ুব শাহির। প্রায় দুই দশক ধরে চলা এসব অসীম সাহসী সংগ্রামী পদচারণার সবটা সময় জুড়ে কমিউনিস্ট পার্টির ছিল এক অনন্য গৌরবোজ্জ্বল অগ্রবর্তী ভূমিকা। ধারাবাহিক সংগ্রামের কিছু কিছু ক্ষেত্রে এবং সময়ে সময়ে এই ভুমিকা ছিল নির্ধারক, ক্রান্তিকালীন এবং সাময়িকভাবে নেতৃত্বমূলক। তার ওপর ভিত্তি করে জাতি এগিয়ে যেতে পেরেছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পথে। রচিত হয়েছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ সশস্ত্র পর্বের ঐতিহাসিক পটভূমি। ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নকে সাথে নিয়ে নিজশ্ব কমান্ডে ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনী’ গঠন করে এবং সর্বমুখী পন্থায় সিপিবি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। দেশকে হানাদার মুক্ত করে স্বাধীন দেশে পার্টি প্রকাশ্যে কাজ শুরু করেছিল। অনেকের মনে একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন হলো- শুরুর প্রায় আড়াই দশক ধরে জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করার মতো যে শক্তি-সামর্থ্য কমিউনিস্ট পার্টির ছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেটি অনেকটা পরিমানে অব্যাহত থাকলেও, পরবর্তীতে তা অনেকটা দূর্বল হয়ে গেল কেন? একথা অস্বীকার করার উপায় নেই পার্টিতে আগাগোড়া একধরণের আওয়ামী নির্ভরতার যে প্রবনতা ছিল তার ফলে পার্টির স্বাধীন উদ্যোগ ক্ষুন্ন হয়েছিল এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রশ্নটি (সেক্ষেত্রে বাম-গনতান্ত্রিক’ বিকল্প গড়ার চিন্তাটিকে) যথার্থভাবে সামনে আনা হয় নাই। -ইত্যাদি। এসব ‘ডান-বিচ্যুতি’ সম্পর্কে আত্মসমালোচনা করা হলেও পার্টি এবং এমনকি পার্টি নেতৃত্বের মধ্যে বিরাজমান তার ভিত্তি ও উৎস উৎপাটিত করা যায়নি। এতদসত্বেও, ‘৯০-এর দশকে এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসন উচ্ছেদের সংগ্রাম এবং উত্তাল ট্রেড ইউনিয়ন, ক্ষেতমজুর, কৃষক, পেশাজীবী, নারী, সংস্কৃতি, প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের মধ্য দিয়ে পার্টি বিপুল মর্যাদা অর্জন করেছিল। তাকে ধরে অগ্রসর হওয়ার যে সুযোগ ছিল, তা কাজে লাগানো যায়নি। এমনকি পার্টির অর্জিত শক্তি ও প্রভাবকে ধরে রাখাও সম্ভব হয়নি। গত তিন দশকে তা বরঞ্চ অনেকটা পরিমানে ক্ষয়ে গেছে। কী কারণে এমন হলো? সবাই বলবে যে এর একটি প্রধান কারণ হলো- আন্তর্জাতিকভাবে ও জাতীয়ভাবে অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতির পেছন দিকে চলে যাওয়া । তবে এ কথাও ঠিক যে, গত তিন দশক ধরে কমিউনিস্ট পার্টিকে, ভিন্ন ধরনের হলেও, কিছু নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তার মধ্যে একটি হলো- ভেতর থেকে পরিচালিত ‘পার্টি বিলুপ্ত করার’ যে ষড়যন্ত্র পার্টির ‘নাম-ডাক অয়ালা নেতারা’ করেছিল তা মোকাবেলা করে পার্টুকে অগ্রসর হতে হয়েছে। অপর একটি কারণ হলো- ‘৯০-এর পর থেকে তাকে শাসকশ্রেণি রাজনীতিকে ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’ কেন্দ্রীক ‘দ্বি-মেরুকরণের’ কাঠামোতে আটকে ফেলার যে নীল নকশা কার্যকর করেছে পার্টি তার কাছে নত না হয়ে তার স্বাধীন ভূমিকা ও নীতিনিষ্ঠতা অটুট রেখেছে। ফলে তাকে চতুর্দিক থেকে প্রবল আঘাতের সম্মুখীন হয়েছে। ‘চলতি হাওয়ার’ বিরুদ্ধে দাড়িঁয়ে পার্টিকে পথ চলতে হয়েছে।– ইত্যাদি। একথা সত্য যে চলতে গিয়ে পার্টি কিছু ভুল-ত্রুটি করেছে। তবে, সেক্ষেত্রে ভরসা হলো- পার্টি সবসময়ই আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ভুল-ত্রুটিগুলো সংশোধন করে চলেছে। সেই সাথে একথাও ঠিক যে অনেক বিষয়ে পার্টিতে রয়েছে প্রচুর ঘাটতি ও দূর্বলতা। বিপ্লবী ধারায় কর্মকাণ্ড দ্বারাই সেগুলো দূর করা সম্ভব। পার্টি সে চেষ্টা করছে। পার্টি কিছু ভুল-ত্রুটি করেছে। তবে, আরও বড় সত্য হলো – পার্টি বড় কোন মৌলিক ধরণের ভুল করেনি বা ভুল পথ অনুসরণ করেনি। ‘রাজনীতির সর্বগ্রাসী রুগ্নতার’ মাঝেও সিপিবি তার প্রগতিমূখীনতা-দেশপ্রেম-সাহস-ত্যাগ-নীতিনিষ্ঠতার ঐতিহ্য ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে চলতে পেরেছে। তা বজায় রেখেই সে শ্রেণি-সংগ্রাম ও গণ-সংগ্রামের ধারা এগিয়ে নিতে তৎপর রয়েছে। সেক্ষেত্রে সে নতুন নতুন দিগন্তও প্রসারিত করছে। ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসনের অবসান, ‘বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প’ শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা, সাম্রাজ্যবাদ-লুটপাটতন্ত্র- ফ্যাসিস্ট-দূঃশাসনের অবসান- ইত্যাদি প্রশ্নে সে একাগ্রতার সাথে সংগ্রাম করে চলেছে। সব মিলিয়ে বলা যায় যে, জোয়ার-ভাটার এই দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনে এখন যে একধরনের সাময়িক ‘ভাটার পর্ব’ চলছে। তবে তা আস্তে আস্তে কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা জোরদার হচ্ছে। আবার যে জোয়ার আসবে, তার লক্ষন দেখা দিতে শুরু করেছে।। সেরকম যেন না হতে পারে সেজন্য বৈরী শত্রু-শক্তি আজ মড়িয়া হয়ে উঠেছে। তারা ‘জোয়ারের’ অবশ্যম্ভাবী পুনঃআবির্ভাবকে রুখতে চায়। সেজন্য একদিকে দমন-পীড়ন বাড়িয়ে দিচ্ছে। এদিকে, ‘পুজিবাদের নয়া-উদারবাদী বিশ্বায়ন’ জন্ম দিয়েছে কুৎসিত ভোগবাদ, লোভ-লালসা প্রসূত পন্যায়ন, উৎকট প্রদর্শনবাদ, মানবিকতা বর্জিত স্বার্থপরতা-আত্মকেন্দ্রীকতার এক নারকীয় জগৎ। এই বাস্তবতায় রাজনীতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে বর্ণবাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিবাদী, যুদ্ধবাদী প্রবনতা। শোষকশ্রেণির হাতে ‘বি-রাজনীতিকীকরণ’ শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে উঠেছে। কমিউনিস্ট সহ প্রগতিবাদী-মানবতাবাদী-বিবেকবান শক্তিকে এই দুষিত উজান স্রোতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পথ চলতে হচ্ছে। অন্যদিকে, পার্টির ও প্রগতির সেনানীদের বিভ্রান্ত করার জন্য সংস্কারবাদ, সুবিধাবাদ, এনজিও ও সুশিল-সমাজ কার্যক্রম, ‘মন্দের ভালো’ তত্ত্ব, আপোসকামিতা — ইত্যাদির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে পার্টির বিপ্লবী প্রাণ-শক্তিকে খর্ব করার চেষ্টা চলছে। এ অবস্থায় ‘বারে বারে হেলিস নে ভাই —‘ বিশ্বকবির এই বানী মনে রেখে দৃঢ়তা, একাগ্রতা ও সাহসের সাথে কমিউনিস্ট পার্টিকে তার কর্তব্য পালনে এগিয়ে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে পার্টির শুরুর দিনগুলো সহ উজান-ভাটি উভয় পরিস্থিতিতে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা পার্টির জন্য নিরন্তর পথ চলায় অনুপ্রেরণার অনন্ত উৎস এবং পাথেয় হয়ে আছে ও থাকবে।
লেখক – রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট। সাবেক ভিপি ( ঢাবি), সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ( সিপিবি)
৮/৩/২৫