শনিবার, রাত ১১:১০, ১৬ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শনিবার, রাত ১১:১০, ১৬ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কোরানে সিয়াম

সদর উদ্দিন আহ্‌মদ চিশ্‌তী

সূরা বাকারা (২ঃ ১৮৩-১৮৯) |

২ঃ১৮৫। অনুবাদ-রমজান মাস ইহাতে কোরান নাজেল হয় যাহা মানুষের জন্য একটি হেদায়েত এবং (নাজেল হয়) হেদায়েতের ব্যাখ্যা এবং ফোরকান। অতএব তোমাদের মধ্যে যে এই মাসকে প্রত্যক্ষ করে তবে সে-ই সিয়ামটি করে।এবং তোমাদের মধ্যে যে পীড়িত অথবা ভ্রমণের উপরে আছে তাহার গণনা পরবর্তী কালসমূহের প্রতিটি হইতে (গ্রহণীয়)। তোমাদের সহিত যাহা সহজ তাহাই আল্লাহ ইচ্ছা করেন এবং তোমাদের সহিত যাহা কঠিন আল্লাহ তাহা ইচ্ছা করেন না; এবং গণনাটিকে কৃতকার্য করিয়া তোলার জন্য এবং যে হেদায়েত তোমাদিগকে দেওয়া হইয়াছে তাহার (আদর্শের) উপরে আল্লাহকে বড় করিয়া তোলার জন্য এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতে পার।

#ব্যাখ্যা : “কোরান নাজেল হওয়া” কথাটি সর্বকালীন এবং সার্বজনীন একটি বিষয়। সাধকের নিকট তাঁহার আত্মদর্শনের পূর্ণাঙ্গ যে পাঠ তাঁহা হইতে নাজেল হয় বা বাহির হয় তাহাকেই বলা হইয়াছে কোরান। পূর্ণাঙ্গ সাধকের আত্মদর্শনের পাঠকে অর্থাৎ অভিব্যক্তিকে কোরান বলে। আরবী কোরান ইহাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। কোরানই মানুষের জন্য একমাত্র হেদায়েত। ইহা সাধকের “রমজান মাস” ব্যতীত অর্থাৎ শিরিক পরিত্যক্ত কাল ব্যতীত অন্য সময় নাজেল হয় না। চরম সাধক হইতে আগত কোরান অর্থাৎ পরম একজন গুরু হইতে আগত কোরান ইনসানের জন্য হেদায়েত। ইনসান হইতে নিম্ন পর্যায়ের মানুষের জন্য

হেদায়েত নয়। সৎগুরু তাঁহার আপন হইতে আগত কোরান শিক্ষা দিয়া অধীনস্থ

ভক্ত জীবগণকে ইনসান বানাইয়া থাকেন (৫৫ঃ১-৩)। এইরূপ ইনসানের জন্যই কোরান হেদায়েত। জীব প্রকৃতির মানুষের জন্য কোরান বোধগম্য বা যোগ্য নয় ৷ গুরু হইতে যোগ্য শিক্ষা লাভের পর তাহারা কোরানের জ্ঞান লাভের যোগ্যতা অর্জন করিয়া থাকে ।

সায়েমের নিকট তাঁহার সিয়ামের কালে হেদায়েতের ব্যাখ্যা এবং ফোরকান নাজেল হয়। মানব জীবন সার্থকভাবে মুক্তির দিকে পরিচালনার জন্য সামাজিক ও ব্যক্তি জীবনের যত প্রকার হেদায়েত (Guidence) প্রয়োজন হইতে পারে তাহার সর্ব দিকের জ্ঞানে সায়েম পরিপূর্ণ হইয়া থাকেন। সিয়াম সাধনার সময়ে সিয়ামের ফলশ্রুতি স্বরূপ সায়েমের নিকট ফোরকান নাজেল হয়। অর্থাৎ ভাল-মন্দ প্রভেদ জ্ঞান তথা সর্ব বিষয়ের পার্থক্যকারী জ্ঞান নাজেল হয়, যাহা দ্বারা বস্তুর বন্ধন হইতে মুক্তিপথের সঠিক নির্দেশনাপ্রাপ্ত হওয়া যায়।

সিয়াম করা অর্থ সপ্ত ইন্দ্রিয় দ্বার দিয়া যাহা কিছু বিষয়বস্তু মস্তিষ্কে প্রবেশ করে তাহার মোহ বর্জন করা। এইরূপ বর্জনের গুরুত্ব যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় অর্থাৎ উপলব্ধি করে সেই ব্যক্তিই কেবল এই মাসে সিয়াম করে। অন্য লোকেরা কেবল মাত্র পানাহারের সময়সূচীর বিধান পালন করিয়াই আত্মপ্রসাদ অনুভব করে ।

পীড়া এবং ভ্রমণ,এগুলি দৈহিক ও মানসিক উভয় প্রকার হইয়া থাকে। মানসিকভাবে পীড়িত এবং বিষয়বস্তুর উপর মানসিক ভ্রমণে রত ব্যক্তির পক্ষে সিয়াম পালন করা সম্ভবপর হয় না বিধায় তাহাদের প্রতি নির্দেশ হইল যেন তাহারা সিয়াম পালনের উপযুক্ত মানসিক যোগ্যতা অর্জনের পর উহা “পালন করিতে” যত্নবান হয়। “পালন করা” কথাটি এখানে নাই, গণনা করিবার কথা রহিয়াছে। কোরানের কথা হইলঃ পরবর্তী কালসমূহের অর্থাৎ প্রতিটি ধর্ম

আগমনের কালসমূহ হইতে আগমনকারী সকল ধর্মকে এক এক করিয়া গণনা করা। ইহার অর্থ আগমনকারী প্রতিটি ধর্মই যেন তাহার জ্ঞাতসারে আগমন করে এবং বিদায় গ্রহণ করে। ইহার ফলে বস্তুবাদের মোহের ছাপ তথা শিরিক বা সংস্কার মস্তিষ্কে আবদ্ধ হইয়া থাকে না, সকলই পরিত্যাক্ত (Rejected) হইয়া যায়। ইহাই সিয়ামের মূল কথা। সিয়ামের অভ্যন্তরীণ কথাটি প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্যই আনুষ্ঠানিক সিয়াম পালন ক্ষেত্রেও দৈহিকভাবে অসুস্থ এবং দৈহিক ভ্রমণকারীর সিয়াম পালন নিষিদ্ধ করিয়া তাহা পরে পালন করা ওয়াজেব অর্থাৎ অবশ্য পালনীয় করা হইল।

“সহজ” অর্থ জান্নাতের জিন্দেগী এবং “কঠিন” অর্থ জাহান্নামের জিন্দেগী

(৮৭ঃ ৮) (৯২ঃ ৭)। আল্লাহতা’লা রবরূপে মানুষের সঙ্গেই আছেন। তিনি কখনও

ইচ্ছা করেন না যে, তিনি মানুষের কঠিন অবস্থার সঙ্গে অবস্থান করেন। বরং তিনি মানুষের সহজ অবস্থার সঙ্গে স্থায়ী হইয়া থাকিতে চাহেন। কিন্তু মানুষ কার্যকরিভাবে ইচ্ছা না করিলে তাহার “সহজ জীবন” আল্লাহতা’লা তাহাকে দান করিতে পারেন না, অর্থাৎ জান্নাত এবং তদূর্ধ্বের স্থান দান করিতে পারেন না।ইহা তাহারই রচিত বিধান।

অতএব সিয়ামের যে হেদায়েত বা নির্দেশ আমাদিগকে দেওয়া হইয়াছে সেই নির্দেশের উপরে আমল করিয়া আমাদের মধ্যে আল্লাহকে বড় করিয়া তোলার জন্য ধর্মসমূহের গণনাকার্যের অনুশীলনকে কৃতকার্য করিয়া তোলা একান্ত প্রয়োজন। নির্ধারিত নিয়মে গণনাকার্য সম্পাদন করিতে থাকিলে বস্তু মোহের ছাপ তথা শিরিক হইতে মুক্ত হওয়া সম্ভব হইবে এবং ইহার ফলে আল্লাহ আমাদের মধ্যে জাগ্রত হইয়া উঠিবেন। সকল হেদায়েত মানুষের নফসের উপরেই দেওয়া হয়, নফসের উপরে আল্লাহকে বড় করিয়া তুলিবার জন্যই হেদায়েত। নফস প্রাধান্য পাইলে মানুষের মধ্যে আল্লাহর জাগরণ হয় না।সিয়াম সাধনায় বস্তুর মোহবন্ধন হইতে মানুষ মুক্ত হইয়া যায়।মুক্ত মানুষ প্রকৃতিকে জয় করিয়া পুরুষে পরিণত হন এবং তখনই কেবল আল্লাহর প্রতি মুক্তির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ সম্ভব হয়।

চলবে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top