কেকা অধিকারী
(বাড়িওয়ালী বান্ধবী রোমানা আপাকে)
আমার আগে এ বাসাটিতে যে বাস করতো সে ছিল ২৮ বছরের সুঠামদেহী এক সুদীর্ঘ তরুণ। শুনেছি তার নামেই এ বাড়ির নাম হয়েছিল- বাঁধন ভিলা।
তিনতলার দুটো বড়সড় খোলামেলা, পাখি বসা বারান্দাসমেত যে আড়াই রুমের বাসাতে আমি থাকি সে বাসাটিকে আমার বড্ড আপন লাগে। এ বাসায় প্রাচুর্যের কোন নিদর্শন নেই কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করার প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর প্রাচুর্য আছে। এখানে আছে আলো বাতাসের অবাধ যাতায়াত, এর স্যানিটারী ও অন্যান্য ফিটিংসগুলো বেশ মজবুত। দরজাগুলো, জানালার গ্রীলগুলো বেশ শক্তপোক্ত। মানে ঢাকার সাধারণ বাসাগুলোর ভাড়াটিয়ার জন্য যে লক্করঝক্কর মানের জিনিস দেয়া হয় তার মতো নয়।
তবে বাসাটির সবচেয়ে যা ভালো লাগে তা হলো দুটি বারান্দা আর রুমের মধ্যকার দুটি স্লাইডিং ডোর৷ দরজা দুটো খুললেন কী পুরাই ম্যাজিক! দু রুমে আপনি পেয়ে যাবেন বিশাল দরজা আকারের দুটো আয়না। ঢাকা থেকে আমি কোন ড্রেসিং টেবিল আনতে পারিনি। অথচ শাড়ি আমার রেগুলার পোশাক। আয়না ছাড়া একা একা কি শাড়ি পরা সম্ভব? আমার সমস্যার এমন সমাধান তো ছিল কল্পনাতীত!
ঘরটায় থাকতে গিয়ে সন্দেহ থাকে না যে এর প্রতিটি অংশকে বসবাসের জন্য সর্বোচ্চ সুবিধাজনক করতে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। আধুনিক ও প্রাচীন বাস্তু ভাবনার সংমিশ্রণে তৈরি এ বাড়ি।
তিনতলা বাড়ির নিচতলা ফাঁকা। দোতলায় থাকেন বাড়িওয়ালী রোমানা আপা ও তার কিশোরী নাতনি সারা। তিনতলায় আমি। আমাদের তিনজনের আড্ডা বসে মাঝে মধ্যেই। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া বাড়িওয়ালী আপা আমারই বয়সী। আমাদের মধ্যে অনেক কথা হয়। তিনি আমার গল্প করেন কাছেই তার বিয়ে দেয়া কন্যা সুমি আর স্বজনের কাছে। এভাবেই একদিন আমি আবিষ্কার করি আমার নতুন পরিচয় – কন্যা সুমি সবার কাছে আমার পরিচয় দেয় “মায়ের বান্ধবী।”
এভাবেই বাড়িওয়ালী আপা কখন যেন আমার সত্যি সত্যি বান্ধবী হয়ে গেছেন। সারাদিন বিরামহীন কাজ করতেই থাকেন তিনি। নিজ হাতে বাড়ির সব কাজ করেন। এই হয় তো গ্রামের বাড়ির সরিষা ছাদে শুকাতে দিলেন, একটু পরেই হয়তো নিচতলায় ছুটলেন দরজা ধাক্কানো দরিদ্র ভিখারিদের নিজ হাতে রান্না করা খিচুড়ি মাংশ দিতে।
আমার বাইরে যাওয়া আসার সময়ে দেখতে পাই তিনি জায়নামাজে পরে আছেন। নিজের ঘর থেকে হঠাৎ হঠাৎ শুনি কান্নার আওয়াজ। আমি জানি কান্নাটা করছেন আমার বাড়িওয়ালি বান্ধবী আপা।
আমি এ বাসায় আসার আগে বাসাটা মাস দেড়েকের মতো খালি ছিল। তার আগে বাসাটাতে থাকতো আপার একমাত্র পুত্র বাঁধন। ঘরটা সে-ই নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছিল। চাকরি খুঁজতে শুরু করেেছিল ছেলেটা। মায়ের সাথে তার নিজের বিয়ে, ভাবী বধু নিয়ে কথা হতো। মা ছেলের বাসরের বিছানায় পাতবেন বলে লাল চাদরে ফুল তুলছিলেন। আপা সে অর্ধ সমাপ্ত চাদরটি আমাকে দেখিয়েছেন। পুরুষ পাখির মতো সঙ্গীনিকে তুষ্ট করতে বাঁধনও ঘরটার প্রতিটি কোনা সাজাচ্ছিল।
এমন সময় বাঁধন হঠাৎ অসুস্থ হলো। চিকিৎসা করাতে গিয়ে ধরা পড়ল ওর ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। ফোর্থ স্টেজ। দেশে বিদেশে চিকিৎসা চললেও জীবন তাকে খুব বেশি সময় দেয়নি। ২০২৩ এর অক্টোবরের ২ তারিখে বাঁধন মায়ের কোল ছেড়ে করুণাময়ের চিরন্তন আবাসে আশ্রয়ে নিয়েছে।
বাঁধনের বাসাটাতেই আমি থাকছি। এখানে আমার ও দোতলার দরজা সাধারণত খোলাই থকে। আমার বাসায় মাঝে মাঝেই বাড়িওয়ালী আপা হঠাৎ চলে আসেন। হাতে থাকে খাবারের বাটি। তাতে থাকে আমার জন্য তরকারি, আচার কিম্বা বিশেষ কোন মিষ্টি। আমি কী খাই, না খাই তা নিয়ে তিনি সদা উদ্বিগ্ন। তবে মনে হয় তিনি আমাকে যত্ন করার পাশাপাশি আরেকটি কারণে আমার বাসায় আসেন, তিনি আসেন ছেলের উপস্থিতি অনুভব করতে।
মেয়ে সুমী নিজের বড় মেয়ে সারাকে এ বাড়িতে রেখেছে নানীকে সঙ্গ দিয়ে স্বাভাবিক রাখতে। নিজে ছোট মেয়ে কথামালাকে (নামটি আমার দেয়া) নিয়ে প্রায়ই চলে আসে মায়ের দেখভাল করতে। তখন সেও ঘুরে যায় আমার ঘরে। ঘুরে ফিরে ছোট ভাই বাঁধনের গল্প করে। ও কোথায় কোন ফার্নিচারটা রেখেছিল আমাকে বলে- এখানে বাঁধন উঁচু ম্যাট্রেস দিয়েছিল। ওখানে ছিল ওর সাউন্ড সিস্টেম। ওর মেয়েরাও আমার বাসায় আসে। এসে বলে,”মামার রুমে আমরা এখানটায় দাঁড়িয়ে গান ছেড়ে নাচতাম। মামা অনেক আদর করতো।”
এভাবে আমার প্রতিদিনং বাঁধনের কথা জানা হয়ে যায়। আমি ঘরের বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবি বাঁধন এভাবে নিজেকে দেখতো। বাথরুমে পায়ের পাতা উঁচু করের্্যাকে শুকনা কাপড় রাখতে রাখতে ভাবি, ছেলেটা সত্যি সত্যি অনেক লম্বা ছিল। বড় ডোর আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে মনে হয় ছেলেটা এখানে দাঁড়িয়ে কত ভাবেই না নিজেকে দেখেছে! নীল আকাশের তারা হয়ে যাওয়া ছেলেটা কি এখনও এ আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে এ ঘরে আসে? এ ঘরের মায়া কি কখনও ওকে টানে না? চলে যাওয়া মানুষগুলো কি এপারের সব ভুলে যায়? নিজের বারান্দা, বিছানা, মা, বোন, ভাগিনী? সব?
ভাই চলে যাওয়ার পরে এবার প্রথম ইদ আসছে। মা একা ঘরে কান্না করবে সারাটা সময়। তাই সুমি মাকে তার শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছে। আমার অফিস আছে বুধবার পর্যন্ত। আমি হয় তো ইদের ছুটিতে এখানেই রয়ে যাব। রাস্তার ভোগান্তির কথা মনে হলে যেতে ভয় হয়। ওরা চলে যাওয়ার আগের রাতে ওদের সাথে দেখা করতে গেলাম। সারা আমাকে ইদে কী কী কিনল দেখাচ্ছে। ওর জন্য নেয়া হয়েছে সায়রা নামের পোশাক, ছোট্ট বোনের জন্য সুন্দর জামা। ওর মায়ের পাওয়া উপহারগুলোও দেখালো।
এবার ইদে বাড়িওয়ালী আপাও অনেকগুলো সালোয়ার কামিজ গিফট পেয়েছেন। ম্লানমুখে ভাইয়েরা কোনটা, বান্ধবীরা কোনটা তাকে দিয়েছেন আমাকে বলছিলেন। এক সময় তিনি অন্য রুমে চলে গেলেন। একটু পরে হাতে করে ছোট্ট কিছু একটা নিয়ে ফিরে এলেন-
– আপা, আপনি কি এটা পরবেন? অসুস্থ হওয়ার মাত্র ক’দিন আগে বাঁধন কক্সবাজারে গিয়েছিল। আমার জন্য নিয়ে এসেছিল। আমিও তো পরব না। আপনি পরেন।
আমি যন্ত্রচালিতের মতো হাত বাড়িয়ে ছোট্ট জিনিসটা নিলাম -শঙ্খ কেটে বানানো কানের টপ। আমি কেঁপে উঠলাম। চলে যাওয়া ছেলে পছন্দ করে মায়ের জন্য নিয়ে এসেছিল। সে জিনিস আমি পরব? আপা সেই আবেগের জিনিসটি আমাকে দিলেন! আমি হাতে করে কানের টপটি ঘরে নিয়ে এলাম।
আজ ইদ। একা আছি আমি। বন্ধু মিলির কাছে শেখা রেসিপিতে লাচ্ছা সেমাই রান্না করেছি। রান্না ঘর থেকে বেডরুমে আসতে আয়নায় নিজের ছায়াটি দেখলাম। অথচ মনে পড়ল কোনদিন না দেখা বাঁধনের কথা। ড্রয়ারে গুছিয়ে রাখা কানের টপটি বের করলাম। টপ জোড়া হাতে নিয়ে বললাম, “বাবা বাঁধন, মাকে দেয়া তোমার উপহার কানে পরে আমার এবারের একাকী ইদ উদযাপন হবে।”
টপটি কানে পড়লাম। আয়নায় নানাভাবে নিজেকে দেখলাম।
-আচ্ছা বাবা, এ দুলে আন্টিকে কি সুন্দর লাগছে? ঠিক তোমার মায়ের মতোন?
কেকা অধিকারী
১৩ এপ্রিল ২০২৪