নজরুল ইসলাম
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, পুন্ড্র বিশ্ববিদ্যালয়, বগুড়া। চেয়ারম্যান, আদিবাসী গবেষণা পর্ষদ
ভারতের আদিবাসী সাঁওতাল জনগণ যখন অলচিকি বর্ণমালা আবিষ্কারের শততম বার্ষিকী উৎযাপন করছে পরম শ্রদ্ধায়, তখন বাংলাদেশে বিতর্ক চলছে সাঁওতালি বর্ণমালা কি হবে? মূলত এ বিতর্কের পেছনে কাজ করছে খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলগুলো।এরা মূলত আদিবাসীদের বাপ দাদার ধর্ম কেড়ে নিয়ে, তাদের দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে ধর্মান্তরিত করছে। আদিবাসীদের শিক্ষার নামে মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে রোমান ভাষায় সাঁওতালি পাঠ্যপুস্তক তৈরি করে স্কুলগুলোতে পাঠদান করছে। এই মিশনারিগুলোই আদিবাসীদের ধর্ম ও ভাষার শত্রু। ইংরেজদের আগমনের হাত ধরে, খ্রিস্টান মিশনারীগুলো তৎকালীন ভারতবর্ষে প্রবেশ করে আদিবাসীদের ধর্মান্তরিত করার জন্য। ভারত ও বাংলাদেশের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় অসংখ্য আলো ঝলমলে গির্জা দেখতে পাবেন, গির্জা গুলো সাঁওতাল, ওরাও, মুন্ডা, পাহান বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ধর্মান্তকরণের কাজে লিপ্ত। যে সকল জাতি সত্ত্বার মানুষ আদিবাসীদের নিজ ধর্ম ছেড়ে ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণ করেন মূলত তাদের সন্তানের লেখাপড়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এই মিশনারী পরিচালিত স্কুল সমূহ। আমি গবেষণা এলাকায় কাজ করার সময় লক্ষ্য করেছি, পূর্বে এ মিশনারি স্কুল গুলোতে কোন বেতন নেওয়া হতো না। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল বিনি পয়সায়। মূলত এটা ছিল, ক্রিশ্চান ধর্মের মহত্ব প্রচারের লক্ষ্যে। বর্তমানে এ স্কুলগুলোতে বেতন ভাতার বিনিময়ে শিক্ষাদান করা হয়।চিকিৎসার জন্য টাকা নেয়া হয়।
এ সমস্ত মিশনারিগুলো ও তার দালালেরা সাঁওতালদের বাপ দাদার লালিত ধর্মের মতই, তাদের মূল বর্ণমালা কেড়ে নিয়ে রোমান হরফ চালু করতে চায়।উল্লেখ্য যে আজ থেকে একশ বছর আগেই সাঁওতালি পন্ডিত রঘুনাথ মুর্মু সাঁওতালি বর্ণমালা অলচিকি প্রচলন করেন। অলচিকি ভাষার অসংখ্য গল্প কবিতা গান রয়েছে, এ ভাষায় রচিত হয়েছে সাঁওতালি জীবনের অসংখ্য সুখ- দুখের কাহিনী। সাঁওতালি ভাষার বেশকিছু গ্রন্থ আমার সংগ্রহে আছে। ভারত ও বাংলাদেশের একশ্রেণির এনজিও, দালাল বুদ্ধিজীবী অলচিকির পরিবর্তে রোমান হরফে সাঁওতালি ভাষা লেখার পক্ষে মতামত দিয়ে যাচ্ছেন । একদল পথভ্রষ্ট সাঁওতালি বুদ্ধিজীবী নিজ ভাষা ও বর্ণমালার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে স্বজাতির বিরোধিতা করছেন। যা হবে আত্নঘাতী। এ বিতর্কের অবসান হওয়া প্রয়োজন। আমার গবেষণায় উঠে এসেছে, অলচিকি বর্ণমালায় সাঁওতালি ভাষার পাঠদান সম্ভব। যে সমস্ত মিশনারিগুলো, বা বুদ্ধিজীবীগণ এ বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন, দয়া করে থামুন। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, একটি জাতির ভাষা বা বর্ণমালা কেবলই নিছক কিছু প্রতীক বা চিহ্ন নয়। এর সাথে যুক্ত আছে, একটি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, জাতিগত ইতিহাস,ঐতিহ্য, সমৃদ্ধি । কোন জাতির ভাষার সাথে যুক্ত থাকে তার রুপকথা, লোকগাঁথা, গল্প কবিতা, গান, শ্লোক জীবনের আনন্দ বেদনার কাব্য।একটি জাতি কোন ভাষায় কথা বলবে, মনের ভাব আদান প্রদান করবে, তার সাহিত্য রচনা করবে, প্রিয়তমাকে প্রেম নিবেদন করবে, বাবা মাকে শ্রদ্ধা জানাবে সেটি তার নিজস্ব বিষয়, তা চাপিয়ে দেওয়া বা জোরপূর্বক অন্য বর্ণমালায় পরিবর্তন করাই হলো ভাষার প্রতি আগ্রাসন বা নিপীড়ন। যা অন্যায়। একটি ভাষার নিজস্ব গতি আছে, ছন্দ আছে। উপমা, উৎপেক্ষা আছে যা দিয়ে রচিত হয় কবিতা। নিজস্ব সূর আর ছন্দে রচিত হয় গান। এ ভাষার পরিবর্তন মানে একটি জাতিকে শিকড়সহ উপড়ে ফেলা, ধ্বংস করে ফেলা। যে ভাষা ও বর্ণমালা রক্ষার জন্য আমরা ১৯৫২ তে লড়াই করেছি, রক্তদিয়েছি, জীবন উৎসর্গ করেছি। সাঁওতালী বর্ণ মালা অলচিকি পরিবর্তনের ষড়যন্ত্র হলে সাঁওতালি তরুণ তরুণী জীবন দিতে পারে।,তীরধনুক হাতে লড়াই এ নামতে পারে কারণ এ জাতির অতীত ইতিহাস লড়াই সংগ্রামের। এরাই ১৯৮৫-৮৬ খ্রী সাঁওতাল বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছিল ভারতে মাটিতে। আজও তারা লড়ছে জল, জমি, পাহাড়, অরণ্য রক্ষার দাবীতে। এ দাবীর প্রতি আমাদের সমর্থন থাকা উচিত। কারণ আদিবাসী জনগণ তার ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেলে, তাদের জীবন বিপন্ন হলে হারিয়ে যাবে তাদের ভাষা সংস্কৃতি। যে ক্ষতির দায় তথাকথিত সভ্যতা এড়াতে পারবে না।