বৃহস্পতিবার, দুপুর ২:৫৮, ৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বৃহস্পতিবার, দুপুর ২:৫৮, ৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শোক-সন্তাপ

কেকা অধিকারী  

মরে গেল মরি, ওরফে মরিয়ম। গৃহবধূ আফরোজা মরিয়ম। যদিও এ জাতীয় মৃত্যুকে ভদ্র ও মানবিক ভাষায় স্বেচ্ছামৃত্যু বলে, তবে স্থানীয় লোকজন বলছে, “মরি গলায় ফাঁস নিছে।” চেনা-অচেনা লোকের ভীড়ে সারা বাড়িতে পা ফেলার জায়গা পর্যন্ত নাই। থানায় খবর দেয়া হয়েছে। পুলিশ আসার অপেক্ষায় আছে সবাই। অভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে একই স্থানে জড়ো হলেও মানুষগুলোর মুখের অভিব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন। বাড়ির বাসিন্দাদের চোখে মুখে আতংক। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তাদের মুখে আতংকের পাশাপাশি কিছুটা বিরক্তিও লুকানো আছে। আর বাইরের লোকের চেহারায় কৌতুহল প্রকট – বউটা কখন মরল, কেন মরল? সত্যি সত্যিই কি মরেছে, না কি মেরে ফেলেছে? পরিচিতজনদের মুখে বিষ্ময়, ‘সাত চড়ে রা করে না যে মানুষ, সে কি না আত্মহত্যা করল!”

মোট কথা বিশ্বাসদের ভিটা জুড়ে মরা বাড়ির সব লক্ষণই বর্তমান শুধুমাত্র শোকের চিহ্নটুকু ছাড়া। দাফন কাফনের আয়োজন নিয়ে কোন তোড়জোড় নেই। মরিয়ম এখনও ফ্যানে ঝুলছে। পুলিশ এলে তবে লাশ নামবে। তারপর তাদের কথার উপর নির্ভর করছে সব। সেই কোন সকালে থানায় লোক গেছে। অথচ ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পেরোলেও পুলিশ আসেনি।

মরির বাপের বাড়ি গয়েশপুরেও খবর দেয়া হয়েছে। অবশ্য তার বাপ-মা কেউ বেঁচে নেই। বাবা মরেছে তিন বছর, আর মা তো গেছে তার এসএসসি পরীক্ষার পরপর। একেবারে আচানক, তাকে আর তার ছোট ছোট তিনটে ভাইকে রেখে। সেবার গ্রামের স্কুল থেকে মরিয়মই একমাত্র জিপিএ ফাইভ পেয়েছিল। সারা স্কুলে সাড়া পড়ে গেলেও বাড়িতে এ নিয়ে কোন হৈ-হুল্লোড় হয়নি। বরং মা হারানোর বেদনা তীব্রতর হয়েছে। মা যে তার ভালো রেজাল্ট দেখে যেতে পারল না! এমন সময় বাবা মরির বিয়ে ঠিক করলে বাবাকে সে বলেছিল, “বাজান, আমি কলেজে পড়মু।” রাবু খালাকে বিয়ে করতে উতলা বাবা ধমকে উঠেছে,”মাইয়া মাইনষ্যের এতো পড়া কিসের?” মরির পড়াশোনার ইতি ঘটেছে সেদিনই। সেই থেকে সে আর কোনদিন বইয়ের পাতা উল্টায়নি। সকালে বোনের মৃত্যু সংবাদ শুনে মরির দু’ভাই এসেছে। এ বাড়িতে তাদের তেমন আসা-যাওয়া নেই। জবাগাছের পাশে উঠানের এক কোনে পাতা বেঞ্চে এমন মুখ করে বসে আছে যেন বোনের মৃত্যুর জন্য তারাই দায়ী।

অবশেষে সূর্য মাথার উপর এলে দু’জন পুলিশ এসেছে। মরির স্বামী সোলেমান ঘরের বারান্দায় চেয়ারে বসা। তার দৃষ্টি উঠানের দিকে স্থির। পাশে খাটে বসা মরির একমাত্র সন্তান আরমান। সে এ বছর এইচএসসি পাশ করেছে। ক’দিন হলো তার পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। এবারেও সে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। ঘটনার আকষ্মিকতায় সে একটু থমকে আছে।

গ্রাম সালিশ কমিটির সদস্য মরির বড় জা মোমেনা পুলিশ সামলাচ্ছে। “আপনারা আমার সাথে আসেন” বলে ভীড় সরিয়ে সে তাদেরকে মরিয়মের ঘরে নিয়ে গেল।। মোমেনাকে করিৎকর্মা বলতে হয়। পুলিশ লাশ নিয়ে টানাহেঁচড়া করল না। পোস্টমর্টেম ছাড়াই দাফনের অনুমতি মিলল।

বিয়ের পর পরই মরিয়মের পেটে আরমান আসে। সন্তান গর্ভে থাকাকালীন এ সংসারে তার কোন যত্ন হয়নি। তার কিম্বা তার পেটের সন্তানের খোঁজ করেনি কেউ। তখনই সে জেনেছে জীবন মানে দিন পার করা। দায়িত্ব পালনের বাইরে কোন চাওয়া-পাওয়া থাকতে নেই। সারাদিন গাধার মতো খেটে গেলে এই ‘দিন পার করা’টা সহজ হয়। আশা, স্বপ্ন, চাওয়া-পাওয়া, ভালো লাগা, মন্দ লাগারা মনের মধ্যে ঝামেলা পাকাতে পারে না। গর্ভবতী মরিয়ম এক্লামশিয়ায় যায়যায় করতে করতে নির্ধারিত সময়ের আগেই ছেলে আরমানের জন্ম দেয়। মরতে বসেও মরিয়ম কোন যত্ন পায়নি। মরার ঘর থেকে ফিরে এসেও না। কই মাছের প্রাণ যাদের তারা যত্ন ছাড়া এমনিতেই বেঁচে থাকে। তবে তখন থেকে ছেলে তার বড় চাচীর জিম্মায়। পেট থেকে বেরুনোর পর তার আর যত্নের অভাব হয়নি। এখানে মায়ের কোন ভূমিকা নেই। এই একটি সন্তান জন্ম দিয়ে বেঁচে গেলেও মরি সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা হারায়।

শাশুড়ি বেঁচে থাকতে তাকে শুনিয়ে বহুবার তার ছেলেকে বলেছে, “ও সুলেমান, এই এক পোলা দিয়া কি চলব? আর পোলপান লাগব না? তুই আরেকটা বিয়ে কর বাপ।” সোলেমান মায়ের কথার উত্তর দেয়নি। আবার দ্বিতীয় বিয়ের কথাও মুখে আনেনি।
মরিয়মের বড় ভাসুর সুুরুজউদ্দীন প্রবাসী, ত্রিশ বছর যাবত ওমানে চাকরি করে। প্রতিবছর রোজার ইদে এক মাসের জন্য দেশে আসে সে। তার সাথে আসে পরিবার-পরিজনের জন্য নানান উপহার ভরা বড় বড় দুইটা কাগজের কার্টন। কার্টনে বেশি মাল আনা যায়। তাতে মরিয়মের জন্যও একটা শাড়ি থাকে। গত উনিশ বছর ধরে এর কোন ব্যতিক্রম হয়নি। ভালো লাগা, মন্দ লাগা নিয়ে মরিয়ম মাথা না ঘামালেও এই উপহারটা পেতে ওর ভালো লাগে। শাড়িটার সাথে এক ধরনের স্নেহ, ভালোবাসা, সম্মান মিশে থাকে। প্রতিবার সবার সামনে ভাসুর “ছোট বউ, এই লও। এইটা তোমার” বলে কার্টন থেকে তুলে যখন শাড়িটা মরিয়মের দিকে বাড়িয়ে দেয়, তখন এই শাড়িটাকে তার শাড়ি নয়, মনে হয় নিজের অস্তিত্বের স্বাক্ষর। এ যেন সার্টিফিকেট বিতরণ অনুষ্ঠানে পাওয়া বাড়ির সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি সনদ। আহা সার্টিফিকেট! তার নামের আরও একটা সার্টিফিকেট রাখা আছে তাদের স্কুলের আলমারিতে। এসএসসি’তে জিপিএ ফাইভ পাওয়া সার্টিফিকেটটা সে কোনদিন দেখেনি। প্রয়োজন পড়েনি বলে স্কুল থেকে তোলা হয়নি।

ভাসুরের দেয়া সিনথেটিক শাড়িটা সে নিয়ম করে ইদের দিন পরে। তারপর ভাসুর দেশে থাকার মধ্যে আরও দুএকদিন। ছোটবেলায় মা শিখিয়েছিল “কেউ উপহার দিলে তার সামনে সেইটা ব্যবহার করতে হয়। তাইলে মানুষটা খুশি হয়।” ভাসুর খুশি হয় কি না মরিয়ম জানে না। ভাসুরের সাথে তেমন কথাও হয় না। দেশে এলে বাজার সদায় উনিই করেন। বাজার থেকে ‘কী লাগবে’ জিজ্ঞেস করলে সে তার উত্তরটুকু দেয়। শুধু একবার একটু ভিন্ন রকম কথা হয়েছিল তাদের। পনেরো বছর আগে সুরুজ রান্নাঘরে মরিয়মকে ইদের বাজার বুঝিয়ে দেয়ার ফাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল,

-ছোটবউ, একটা কথা, তুমি কিছু মনে কইরো না। মাঝে মধ্যে দুই একজন আমার কাছে মোমেনা আর সোলেমানেরে নিয়া কথা কয়। দেশ থ্যাইকা দুই একটা বেনামী চিঠিও পাই। আচ্ছা, তুমি কি কিছু দ্যাখো? মরিয়ম থমকে যায়। কিছুটা সময় নেয় উত্তর দিতে। ভাবে কী দরকার মানুষটার মনে যন্ত্রণার কাঁটা ঢুকিয়ে দিয়ে। লাভ কিছু নাই। শুধু শুধু মানুষটা কাঁটার বিষে জ্বলবে। পরে গলায় একটু বিষ্ময় মিশিয়ে বলে,

-কই না তো? আমার চোখে তো কোনদিন কিছু পড়ে নাই। তারপর গলায় আরেকটু জোর এনে বলে,

অমন কিছু হলে তো আমার নজরে আসতো।

-তাই তো। লোকের কাজই হইলো বদনাম ছড়ানো।

কথাটা বলে ভাসুর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

সুরুজ মোমেনার দুই ছেলে মেয়ে। মেয়েটি জামাইয়ের সাথে ইতালিতে থাকে আট বছর। তিন বছর হলো তাদের ছেলেটিও বোনের কাছে ইতালি গেছে। ওদের ছেলে আরমানকে তার বাপ আর চাচি মিলে ইতালিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হয় তো ছেলেও ইউরোপের স্বপ্ন দেখে।

গতরাতে খাবার শেষে টেবিলে বসে মোমেনা, সোলেমান এসব আলাপ করছিল। আরমানও সেখানে ছিল। মরিয়ম টেবিল পরিষ্কার করতে করতে তাদের আলাপের মাঝখানে হঠাৎ বলে বসে

আরমান তো ভালো রেজাল্ট করছে। ও বরং ঢাকায় গিয়ে ভার্সিটিতে পড়ুক। তিনজনের বিস্মিত দৃষ্টি মরিয়মের মুখে নিবদ্ধ। ওর কথার বিষয়বস্তুর চেয়ে আলোচনায় ঢুকে পড়ে মতামত দেয়ার ঘটনায় সবার চোখ কপালে উঠেছে। বিষ্ময় সামলে নিয়ে সোলেমান বলে

-তুমি এসবের কী বোঝ? তোমার এ বিষয়ে কথা না বলেও চলবে। তুমি তোমার কাজে যাও। মরিয়মও ততক্ষণে নিজের চেনা অবয়বে ফিরে গেছে। সে এঁটো বাসনগুলো নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। প্রতিদিনের মতো রান্নাঘরের পাশে নেড়ি কুকুরটা তার অপেক্ষায় ছিল। তাকে আসতে দেখে কুকুরটা তার দিকে এগিয়ে আসে। “আহা! অনেক খিদা লাগছে? একটু দাঁড়া। এখনি খাবার দিচ্ছি” বলেই মরিয়ম হাড়িতে লেগে থাকা ভাতটুকু তরকারির বোলে রয়ে যাওয়া ঝোল আর মাছের কাঁটা দিয়ে যত্ন করে মেখে কুকুরের প্লেটটাতে ঢেলে দেয়। কুকুরটা কুঁইকুঁই শব্দে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে খেতে শুরু করলে মরিয়ম রান্নাঘরের গা ঘেষে লাগানো বেল গাছটা একহাতে জড়িয়ে ধরে দাঁড়ায়। রান্না ঘরের লাইটের আলোয় কুকুরটার খাওয়া দেখে কতক্ষণ। কুকুরটা খেতে খেতে মাথা তুললে বারকয়েক ওদের মধ্যে চোখাচোখি হলো। কে বলবে ওটা একটা অবোধ প্রাণী! মরিয়ম আরও কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়েই রইল। এরপর একটু ঝুঁকে কুকুরটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

-ঠিক আছে টমি, তুই ভাত খা। আমি গিয়ে বাসন কয়টা ধুয়ে ফেলি। তারপর মরিয়ম থালাবাসন ধুয়ে কখন ঘুমাতে গেছে কেউ খেয়াল করেনি। ভোরে সোলেমান দেখে যে, সে ফ্যানে ঝুলছে। তার চিৎকারে আশেপাশের বাড়ি থেকে লোকজন জড়ো হয়। সেই থেকে সারাটা দিন বাড়িটায় মানুষের আনাগোনা চলেছে। চলেছে ফিসফাস, নিচু গলায় কথাবার্তা। পুলিশ ঘরে ঢুকে সুইসাইড নোট আছে কি না খুঁজে দেখেছে। বেশি খুঁজতে হয়নি। টেবিলের উপরেই ছিল, গ্লাস চাপা দেয়া। খালি গ্লাস, পানি ছিল না। আরমানের খাতা থেকে ছেঁড়া একটা পৃষ্ঠায় লেখা একটা মাত্র বাক্য – “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়”। পুলিশ পৃষ্ঠাটা হাতে নিয়ে চমকে গেছে, “এতো সুন্দর হাতের লেখা”! তার হাতের লেখার সাথে বাড়ির কারও লেখা মিলল না। মরিয়মের সুন্দর হাতের লেখার খবরটি কারও জানা ছিল না। মরিয়ম যে দু’একটা কথা বলত তা বলত তার নেড়ি কুকুরের সাথে। অন্যদের প্রশ্নের জবাব দিত শুধু। তার মনের হদিশ জানা ছিল না কারো। পুলিশ দাফনের অনুমতি দিলে মরিয়মের ভাইদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তারা বোনকে নিজেদের বাড়িতে কবর দিতে চায় কি না। ভাইয়েরা বলেছে তাদের বোন তো শ্বশুরবাড়িকেই বেশি আপন ভেবেছে চিরকাল, তাই সে চিরদিনের ঘুমটা এ বাড়িতেই দিক। এ বাড়ির কেউ অমত করেনি। পারিবারিক কবরস্থানে নয়, বাড়ির শেষ প্রান্তে বাঁশঝাড়ের পাশে মরিয়মকে কবর দেয়া হয়েছে শেষ বিকেলে। সন্ধ্যা নামতেই লোকজনে গিজগিজ করা বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেছে। যে যার মতো বাড়ির পথ ধরেছে। কৌতুহল ধরে রাখার মতো গল্প মরিয়ম দিয়ে যেতে পারেনি যে তারা থাকবে। তার বিবর্ণ জীবনে মৃত্যু কোন রঙ লাগাতে পারেনি। দু-একটা ধূসর আঁচড় কেটেছে মাত্র। তাই বরাবরের নিরিবিলি বাড়িটা আজও আলাদা কিছু নয়। একটু স্তব্ধ হয়ে আছে এই যা। বাড়ির উঠোনটা মরিয়ম কাদামাটিতে নিকিয়ে রাখতো সব সময়। সকাল থেকে শতলোকের পায়ের পাড়ায় নিকানো উঠোনের বুক মসৃণতা হারিয়েছে। সেখানে এখন জোৎস্নার আলোআঁধারির ছোপ। প্রতিবেশি কারও জ্বালিয়ে দেয়া আগরবাতির গন্ধ সারাবাড়িময়। তাদের কারো বাড়ি থেকে আসা খাবার সামনে নিয়ে টেবিলের দু’প্রান্তে বসে আছে মোমেনা আর সোলেমান। আরমান আছে তার রুমে। ব্যাগ গোছাচ্ছে। একটু আগে বাবা আর চাচিকে জানিয়ে গেছে, ইতালি যাবে না সে। আগামীকাল ঢাকা যাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিং করতে। হঠাৎ রান্না ঘরের কাছ থেকে সমস্ত বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে নেড়িকুকুরটা গগনবিদারী দীর্ঘ ক্যাঁ কেঁউ কুঁইইই আর্তনাদ করে উঠল। তার চিৎকারের করুণ সুর থেকে থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। মরা বাড়িটাতে স্বজন হারানোর বেদনায় এই প্রথম কাঁদল কেউ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top